সমাজ জীবনে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির প্রভাব

  • মো. বজলুর রশিদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সমাজ জীবনে আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির প্রভাব বহুমুখী এবং গভীর। আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনগুলোর যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে।

আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক
আধুনিকতা ও প্রযুক্তির প্রভাব সমাজে বহুবিধ ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনগুলি আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ, কার্যকর এবং সুবিধাজনক করেছে। প্রথমত, যোগাযোগ ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা এখন বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারি।

বিজ্ঞাপন

মোবাইল ফোন, ইমেইল, সামাজিকমাধ্যম এবং ভিডিওকলের মাধ্যমে মানুষ দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে। এটি ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধাজনক হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার ফলে কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষাখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার মান ও পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন কোর্স এবং ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজেই শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছেন। গ্রামীণ এবং দূরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও উন্নত শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া, ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে পারছেন, যা তাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করছে।

তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি, টেলিমেডিসিন এবং অনলাইন স্বাস্থ্য পরামর্শের মাধ্যমে মানুষ ঘরে বসেই চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন।

রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবন রক্ষা এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হচ্ছে। এছাড়া, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যগত জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।

চতুর্থত, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ই-কমার্স এবং অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য ও সেবা সহজেই গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন। ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলি অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদের ব্যবসার পরিসর বাড়াতে পারছেন।

এছাড়া, ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম এবং মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন সহজ ও আরো নিরাপদ হয়েছে।

পঞ্চমত, কৃষিখাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে। মেকানিক্যাল হাল, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, উচ্চ ফলনশীল বীজ এবং কৃষি তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের কাজ সহজ এবং কার্যকর হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, কৃষিখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি হয়েছে।

ষষ্ঠত, পরিবহন ও যাতায়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনে ব্যাপক সুবিধা নিয়ে এসেছে। আধুনিক যানবাহন, জিপিএস প্রযুক্তি এবং অনলাইন রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে যাতায়াত সহজ ও সময় সাশ্রয়ী হয়েছে। এর ফলে, কর্মক্ষেত্রে যাওয়া আসা এবং ব্যক্তিগত যাতায়াত আরো সুবিধাজনক হয়েছে।

সপ্তমত, সামাজিকমাধ্যম এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মানুষের সৃজনশীলতা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে। মানুষ তাদের সৃজনশীল কাজ, শিল্প, সঙ্গীত, লেখালেখি ইত্যাদি সহজেই শেয়ার করতে পারছেন এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করছেন।

এছাড়া, সামাজিকমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারছেন, যা সামাজিক বন্ধনকে আরো দৃঢ় করছে।

অষ্টমত, আধুনিক প্রযুক্তি ও গ্যাজেটের ব্যবহারে গৃহস্থালি কাজ সহজ হয়েছে। আধুনিক রান্নাঘর যন্ত্রপাতি, হোম অটোমেশন সিস্টেম, ক্লিনিং রোবট ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজের সময় ও শ্রম সাশ্রয় করেছে। এর ফলে, মানুষ তাদের পরিবারের সঙ্গে আরো বেশি সময় কাটাতে পারছেন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে।

নবমত, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নে প্রযুক্তির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। নবায়নযোগ্য শক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, স্মার্ট সিটি প্রকল্প এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং পরিবেশ দূষণ কমানোর পাশাপাশি, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাচ্ছে।

সবশেষে, সাইবার নিরাপত্তা এবং তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। উন্নত সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এনক্রিপশন প্রযুক্তি এবং তথ্য সুরক্ষা পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত এবং সংবেদনশীল তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে। এর ফলে, তথ্য চুরি, হ্যাকিং এবং সাইবার অপরাধের ঝুঁকি কমানো সম্ভব হচ্ছে।

সব মিলিয়ে, আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও উন্নতি এনেছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং এর সুবিধাগুলি গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সামাজিক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব, যা আমাদের ভবিষ্যতকে আরো সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে সহায়ক হবে।

আধুনিকতা ও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক
তবে এটাও ঠিক যে, আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির প্রভাবের ফলে কিছু নেতিবাচক দিকও পরিলক্ষিত হয়। আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির প্রভাব সমাজে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে, যা আমাদের নজর এড়িয়ে যায় না। এই নেতিবাচক দিকগুলি সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবার এবং ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলছে।

প্রথমত, সামাজিক সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগে প্রযুক্তির অতি ব্যবহার নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সামাজিকমাধ্যম এবং ডিজিটাল যোগাযোগের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ মুখোমুখি যোগাযোগে কম সময় ব্যয় করছে। এর ফলে, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে এবং মানুষ নিজেদের মধ্যে প্রকৃত সংযোগ হারাচ্ছে। শিশু এবং কিশোররা বেশি সময় ডিজিটাল ডিভাইসের সামনে ব্যয় করছে, যা তাদের সামাজিক এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা হ্রাস করছে।

দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলিও প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত। সামাজিকমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং আত্মসম্মানহীনতার কারণ হতে পারে। সামাজিকমাধ্যমে প্রদর্শিত সুখী জীবনযাত্রা এবং সাফল্যের ছবি দেখে মানুষ নিজেকে হীন মনে করতে পারেন। এছাড়া, ডিজিটাল আসক্তি এবং ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ঘুমের সমস্যা, একাকীত্ব এবং মানসিক চাপ বাড়ছে।

তৃতীয়ত, প্রযুক্তির অতি নির্ভরতা কর্মজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অফিস বা কর্মস্থলে প্রযুক্তির ব্যবহার কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করলেও এর মাধ্যমে কাজের চাপ এবং মানসিক চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে ইমেইল, মেসেজ এবং অনলাইন মিটিংয়ের অতিরিক্ত ব্যবহার ব্যক্তিগত জীবনের সময়কে কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে কর্ম-জীবন ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

চতুর্থত, গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলোর একটি। ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত তথ্য সহজেই অনলাইনে শেয়ার হচ্ছে, যা গোপনীয়তা হানির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সাইবার অপরাধ, তথ্য চুরি, হ্যাকিং এবং অনলাইন জালিয়াতির ঘটনাগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে।

পঞ্চমত, প্রযুক্তির কারণে শারীরিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। দীর্ঘ সময় কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের সামনে বসে থাকার ফলে চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও পিঠের ব্যথা, স্থূলতা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু এবং কিশোররা অল্প বয়সেই এই ধরনের সমস্যায় ভুগছে, যা তাদের ভবিষ্যত শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ষষ্ঠত, প্রযুক্তির কারণে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধেরও অবক্ষয় ঘটছে। প্রচলিত সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক রীতিনীতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে এবং এর জায়গায় পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং আধুনিক ধারার প্রবেশ ঘটছে। ফলে, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

সপ্তমত, গ্রামীণ অর্থনীতির ওপরও প্রযুক্তির কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে কৃষিতে মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কৃষকদের জীবিকা নির্বাহের প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলছে। অনেক কৃষক তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং তাদের আয় কমে যাচ্ছে। ফলে, গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা হ্রাস পাচ্ছে এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সবশেষে, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিক্ষার মান ও পদ্ধতি পরিবর্তিত হচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা সুবিধাজনক হলেও, শিক্ষার্থীদের সরাসরি শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ এবং শিক্ষার সামাজিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করছে। এছাড়া, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সহজলভ্য তথ্যের প্রাচুর্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে তথ্যের মান যাচাই করার ক্ষমতা হ্রাস করছে এবং গভীর চিন্তাশক্তির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।

আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। যদিও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের জীবনকে সহজ এবং সুবিধাজনক করেছে, তবে এর নেতিবাচক দিকগুলি মোকাবিলা করতে সচেতনতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তির সুবিধাগুলি গ্রহণের পাশাপাশি এর নেতিবাচক প্রভাবগুলি মোকাবিলায় আমাদের আরো সচেতন হতে হবে এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।