দুর্নীতি: একালের ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড সমাচার



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে দুর্নীতি বন্ধে 'বিশেষ কমিশন' গঠন এবং ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিচারে 'ট্রাইব্যুনাল গঠন' করার দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তার মতে, 'দুর্নীতির এই মচ্ছব বন্ধ করতে এখনই বিশেষ কমিশন গঠন করুন, দুর্নীতিবাজদের অর্থ সম্পদ বাজেয়াপ্ত, বিচার করে কঠিনতম শাস্তি দিন। ঋণখেলাপী অর্থ আত্মসাৎকারীদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন।'

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে সরকারের আরেক অন্যতম শরিক ১৪ দল জোটভুক্ত গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন বলেন, 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের নীতিগত অবস্থান সব সময়ই সোচ্চার ও সুস্পষ্ট।' বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিরোধী দল বা সরকার-সমর্থক থেকে শুরু করে আমজনতার দরবার পর্যন্ত 'দুর্নীতি' সর্বাধিক আলোচিত ও ধিকৃত বিষয়। এ কথা এখন আর কারো পক্ষেই অস্বীকার করার উপায় নাই যে, সাবেক পুলিশ প্রধান ও সেনা প্রধানের দুর্নীতির চিত্র হিমশৈলের ক্ষুদ্র চূড়া মাত্র, যার সূত্রে বহু ঊর্ধ্বতন সরকারি পদাধিকারীর হাজার কোটি টাকার সম্পদের গোপন জগৎ উন্মোচিত হচ্ছে। এমনকি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিদায়ী বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ পেশাজীবনের শেষপ্রান্তে এসে সবিস্ময়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সরকারের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী কীভাবে কোটি কোটি, এমনকি শতকোটি টাকার মালিক হন?

সন্দেহ নেই, লাগামহীন দুর্নীতির ঘটনাগুলো দেশবাসীকে হতবাক করেছে। যে কারণে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আট সদস্যের আপিল বেঞ্চের বিদায়ী বক্তব্যে বিচারপতি হাফিজ বলেন, দুর্নীতি আমাদের সব অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা অনেক। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাত থেকে অফিস-আদালতকে মুক্ত রাখতে হবে। রাষ্ট্রকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। তাহলে দেশ উপকৃত হবে। মানুষ অযাচিত বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।

বাংলাদেশের 'দুর্নীতি' দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও আলোচিত বিষয়। মালয়েশিয়ায় 'সেকেন্ড হোম', কানাডায় 'বেগমপাড়া', দুবাই-আবুধাবিতে 'মল-মার্কেট' নিয়ে কথা হলেই বাংলাদেশের দুর্নীতির সূত্র সামনে চলে আসে। দুর্নীতির মাত্রা কোন দেশে কেমন, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রতিবছর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই), তাতেও বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি বিদ্যমান। বিগত ২০২৩ সালের জন্য দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। সেই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির মাত্রা বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই এবং যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন রয়েছে, সেসব দেশের চেয়েও বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা বেশি।

ফলে দুর্নীতি যে হচ্ছে, তা আড়াল করা অসম্ভব। বরং এখনই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্নীতির এই বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির সলিল সমাধি হবে। দুর্নীতিবাজরা সাধুর ছদ্মাবরণে দেশের সম্পদ লুটে নিতে থাকবে। এমনকি, তাদের সন্তানরা লাখ লাখ টাকার গরু-ছাগলের ঘটনা ঘটাবে। কন্যারা কোটি টাকার গাড়ির ফুটানি মারবে। স্ত্রীগণ ডুপ্লেক্স বাড়ি ও রিসোর্টের মালিক বনে যাবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা এখানে দেখলাম পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার জন্য সাংবাদিকদের ধমক দেওয়া হয়েছে। অনেক মন্ত্রী এ তথ্যকে অনুমান ভিত্তিক বলে অভিহিত করছেন। এগুলো করে সত্য গোপনের চেষ্টা চালালেও প্রকৃত চিত্র ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। মার্কিন ফিনানশিয়াল ইনটিগ্রেটি ইনস্টিটিউশন দেখিয়েছে যে, বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে কানাডার বেগম পাড়ায়, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে, সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ের আধুনিক শপিংমল, রিয়েল এস্টেট ও হুন্ডি ব্যবসায়। এই টাকার লভ্যাংশও দেশে আসছে না। পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নাই। অথচ প্রবাসীরা বিদেশে হাড়ভাঙা খাটুনীর যে আয় দেশে পাঠায় তার ওপর কর বসানো হচ্ছে। তাদের বিদেশ যাত্রা নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

পরিস্থিতি কতটুকু মারাত্মক হলে স্বয়ং সরকার সমর্থক হয়েও মেনন পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন, 'এই অর্থ সম্পদ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা ফেরত না দেওয়া, ব্যাংক লুট ও দুর্নীতি। ২০০৯ সালে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকার এমন ঋণ এখন ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। পুণঃতফসিলীকরণ ও অবলোপন ধরলে এর পরিমাণ ৪ থেকে ৫ লাখ কোটি টাকা দাঁড়াবে। তিনি বলেন, 'ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে "ব্যাংক কমিশন" গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত। পরের অর্থমন্ত্রী তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর এখন ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তুঘলকি কাণ্ড করছে।'

একই কথা বলা যায় কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে। দেখা যাচ্ছে, ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটের টাকাকে যখন সাদা করার জন্য সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের চেয়ে অর্ধেক কর দিয়ে সাদা করার প্রস্তাব করা হয় তখন সেটা সততার জন্য তিরস্কার ও অসততার জন্য পুরস্কারের শামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে তা কেবল অসাড়ই নয়, সরকারের অতীত অবস্থানের বিপরীত।

দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের ছাপ আজিজ, বেনজির, ছাগলকাণ্ড ছাড়াও সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম খুনের ঘটনায় দৃশ্যমান, যাতে এই দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ—মাদক চোরাচালানি ও অপরাধ জগতের চিত্র বেরিয়ে আসছে। আগেই রাজনীতি ও সংসদে ব্যবসায়ীদের দাপট বেড়েছিল। এবার অপরাধের প্রসঙ্গও যুক্ত হওয়ায় রাজনীতি আরো কোণঠাসা হয়েছে ও দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সংসদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এসব বিষয় গভীরভাবে খতিয়ে দেখা ও আত্মসমালোচনা হওয়া দরকার।

অনেকেই বিশ্বাস করেন, নিষ্ঠুর অলিগার্করা দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই অলিগার্কির স্বার্থ রক্ষার্থে মূল্যস্ফিতি কমিয়ে আনা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থপাচার, ব্যাংকিং খাতে লুট ও নৈরাজ্য, খেলাপি ঋণের বিশাল পাহাড় দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত করেছে। এর থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার, জন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল বর্তমান সময়ের জরুরি কর্তব্য। বাজার সিন্ডিকেট আগের মতো খেলা করছে। মানুষকে তার শিকারে পরিণত করছে। সরকার স্বীকার করছে সিন্ডিকেট রয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো উদ্যোগ নেই।

অতীতেও বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচ পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ হয়েছে। অর্থনীতিবিদগণ সব সময়ই বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই আমাদের প্রবৃদ্ধি আড়াই ভাগ বৃদ্ধি পেত। অতীত আমলের দুর্নীতির বিশ্ব সূচকে আমাদের সেই কলঙ্ক কিছুটা দূর হলেও ওই সূচকে বাংলাদেশ এখনও শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। বরং সরকারি পদ-পদবী ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির যে চিত্র সম্প্রতি বেরিয়ে আসছে তা দেশের ভাবমূর্তি কেবল নয়, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে হতাশা এবং সার্বিকভাবে জনমনে অনাস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।

এহেন মাত্রাছাড়া দুর্নীতির আর্থ-সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক কারণ থাকলেও এর মনস্তাত্ত্বিক কারণটি মোটেও অবজ্ঞা করার মতো নয়। মন ও মানসিকতার দিক থেকে চরম অসৎ, অসুস্থ ও বিকৃত হলেই কেবল একজন মানুষ মাতাল মহিষের মতো অর্থ ও সম্পদের পিছনে ছুটতে পারে। তার প্রয়োজনের চেয়ে হাজার গুণ বেশি সম্পদ কামানোর জন্য অবৈধ পথে পাগলের মতো আচরণ করতে পারে। অতএব, তাদের অপরাধবৃত্তি ও দুর্নীতিপরায়নতার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনের স্বার্থে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা হওয়া দরকার। এতে সাদা ও সাধু সেজে লুটপাট ও দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়া কালো বিড়ালদের শনাক্তকরণ সহজ হবে এবং আইনের আওতায় আনাও সম্ভব হবে।

এক্ষেত্র একটি উপন্যাস স্মরণযোগ্য, যার শিরোনাম 'স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড'। উপন্যাসটি হল স্কটিশ লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন রচিত রহস্য আখ্যান। এটি ১৮৮৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। লন্ডনের আইনজীবী গ্যাব্রিয়েল জন আটারসন তার পুরনো বন্ধু ডক্টর হেনরি জেকিল ও তার অশুভ সত্তা এডওয়ার্ড হাইডের মধ্যকার অদ্ভুত ঘটনাবলির তদন্ত এই উপন্যাসিকার উপজীব্য বিষয়। উপন্যাসিকাটির প্রভাব এতটাই যে এটি ইংরেজি ভাষার অংশ হয়ে ওঠে, এবং "জেকিল অ্যান্ড হাইড" শব্দগুচ্ছ দিয়ে এমন কোন ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যার দ্বৈত সত্তা রয়েছে, সাধারণত খুব ভালো কিন্তু মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত রকমের মন্দ।

কাহিনীতে রয়েছে, ডাক্তার জেকিল নিজের ব্যবহারের জন্য একটি ঔষধ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন যেটি ব্যবহার করলে তিনি বিপরীত চরিত্রের একজন মানুষে পরিণত হয়ে যাবেন অর্থাৎ তার মনের যেসব খারাপ দোষ রয়েছে সেগুলো মুখ্য হয়ে উঠবে এবং তিনি সেভাবেই ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করবেন। আবার আর একটি ঔষধ প্রয়োগ করে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে পারবেন। এভাবেই ডাক্তার তার মধ্যকার ভালো এবং মন্দ এই দুটো স্বভাবকে নিয়ে একই দেহের ভিতর দুটি মানুষকে লালন পালন করতে শুরু করলেন। তিনি খারাপ মানুষটির নাম দিলেন মিস্টার হাইড। এই রকম ভাবে তিনি দিনের বেলায় ডক্টর জেকিল এবং রাতে মিস্টার হাইড হয়ে জীবন যাপন করতে থাকেন।

এক সময় এমন পরিস্থিতি হলো যে তিনি না চাইলেও মিস্টার হাইডে রূপান্তরিত হতে লাগলেন। দেখা গেলো যে তার দ্বিতীয় ঔষধ যা প্রয়োগ করে তিনি মিস্টার হাইড থেকে ডক্টর জেকিল হতেন তা আর কাজ করছে না। ফলে তার মনুষ্যত্বের বদলে পশুত্ব স্থায়ী হতে লাগল। এরই মধ্যে মিস্টার হাইড খুন করে বসলেন এক লোককে। তার মধ্যেকার আত্মগ্লানি থেকে রক্ষা পেতে আত্মহত্যা করলেন আসল ব্যক্তি ডক্টর জেকিল।

আমাদের দুর্নীতিবাজগণ প্রকাশ্যে ভালো মানুষ ডক্টর জেকিল আর গোপনে বা তলে তলে মিস্টার হাইড। সবাই তাকে ভালো মানুষ ও উচ্চ মর্যাদার লোক মনে করলেও নীতি, নৈতিকতা ও আচরণের দিক থেকে তার বা তাদের মধ্যে বাস করে এক বর্বর পশু। গৃহস্থের একদিন যখন সত্যি সত্যিই আসে, তখন চোর ব্যাটা ধরা পড়ে। বাংলাদেশে ধৃতর চেয়ে অধরা দুর্নীতিবাজ অনেক বেশি। যারা অবলীলায় উপরের পদে বসে বড় বড় কথা বলে দেশের পকেট কাটছে। জনগণের ভাগ্য ও সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

মন বিশারদগণ বলেছেন, মানুষের রিপুগুলো আসলেই খুব বিচিত্র, শক্তিশালী ও সক্রিয়, যার একদিকে লোভ, লাভ ও লালসা আর অন্য দিকে আছে সংযম ও শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তোলা মন। এই দুই বিপরীত স্বভাবের মধ্যে চলে অবিরাম যুদ্ধ। অশুভ শক্তিকে দমিয়ে রাখাটাই সভ্যতার মাপকাঠি। যে নেতা, ব্যক্তি, সমাজ, শাসক, প্রতিষ্ঠান যত বেশি সংযমের পরিচয় বহন করে, সে বা তারা তত সভ্য।

কিন্তু দুর্নীতি ও স্তাবকতা সভ্য জগৎকে অন্ধকারে ঢেকে রাখতে সদা-উদ্ধত। এরা নিজের স্বার্থে ও ধান্ধায় শাসকের আনুগত্য দেখায়, মানুষকে মূল্যবোধের কথা বলে। বাস্তবে এর কিছুই তারা বিশ্বাস করে না ও প্রতিপালনও করে না। এরা একটি সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আর্থিক কাঠামো, নৈতিক মানদণ্ড, সুরুচি ও সভ্যতাকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় বিপদের বার্তা।

অতএব, সমাজ, প্রশাসন ও পেশার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভেক ধরে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান হওয়া ও নীতি-নৈতিকতার লালবাতি জ্বালানো একালের 'ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড'দের থেকে সাবধান!

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; চেয়ারম্যান ও প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

রাষ্ট্র ও সরকারে একই ভূত বিরাজমান



মযহারুল ইসলাম বাবলা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের আমলাতন্ত্র নির্ভর ও শাসিত সরকারের শাসনামলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা এবং বেসরমারিক আমলাদের আরব্য রজনীর মতো অর্থবিত্ত, সম্পদের সংবাদগুলো আমাদের ক্রমাগত হতবাক করে দিচ্ছে। দু’চারজনের সংবাদেই আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হচ্ছে না, পুরো আমলাতন্ত্র এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের লাগামহীন দুর্নীতির এবং অর্থ লুণ্ঠনের বিষয়াদি। সাবেক আইজি’র বিষয়ে একটি দৈনিকে তার অর্থ সম্পদের তালিকা প্রকাশের ফলে তথাকথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন বাধ্য হয় তদন্ত করে মামলা দায়ের করতে। অথচ যার বিরুদ্ধে অর্থবিত্তের, সম্পদের পর্বত সমেত অভিযোগ তিনি নির্বিঘ্নে অর্থকড়ি গুছিয়ে দেশ থেকে ভিন দেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাকে কোনোরূপ বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। তার অবর্তমানে কিছুদিন লেখালেখির পর বিষয়টি অন্যান্য বিষয়ের মতো আমাদের স্মৃতি থেকে লোপাট হয়ে যাবে। যেমনটি এ যাবৎ কালের রোমহর্ষক ঘটনাগুলো হারিয়ে গেছে। অপরাধীরা নিরাপদ এবং নির্বিঘ্ন জীবন-যাপন করছেন। আইজি সাহেবের পলায়নের ঘটনার পর ক্রমশ গণমাধ্যমে সেটা প্রায় চাপা পড়েছে।

গত কুরবানি ঈদে ১৫ লক্ষ টাকায় খাসি কেনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং কুরবানিতে কোটি কোটি টাকার পশু কুরবানি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ঝড় ওঠে। ইফাত নামক ছেলেটির ১৫ লক্ষ টাকার ছাগল কেনার ঘটনার পর একে একে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের পুত্র ইফাতের ছাগল কেনার সূত্র ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্রায়াত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক মতিউর রহমানের অবৈধ পন্থায় অর্থবিত্ত, সম্পদের বিবরণের খতিয়ান সম্প্রতি দেশজুড়ে তোলপাড় করছে। দুই স্ত্রী’র নরসিংদী ও ফেনিতে সম্পদের পরিমাণ এবং অবকাঠামোগুলোও নজিরবিহীন। করোনায় আক্রান্ত মতিউর দ্বিতীয় স্ত্রীকে খালি চেক স্বাক্ষর করে দেয়। ওই চেকের মাধ্যমে তিনশত কোটি টাকা দ্বিতীয় স্ত্রী’র হাতিয়ে নেবার সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের গাড়ির বহর। রাজকীয় জীবনাচার। প্রথম স্ত্রীকে কলেজের অধ্যাপনা থেকে ছাড়িয়ে অর্থের জোরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বসানো ইত্যাদি ঘটনাগুলো রূপকথাকেও হার মানায়। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার এবং কানাডায় আমলাদের স্ত্রীদের নামে বাড়ি কেনার হিড়িকে কানাডায় বাংলাদেশি নারীদের মালিকানার বাড়িগুলোকে ‘বেগম পাড়া’ হিসেবে গত ক’বছর ধরে প্রচারণা চলছে। মতিউরের ক্ষেত্রেও কানাডায় সম্পদ ক্রয়ের এবং সন্তানদের সেখানে পাঠিয়ে দেবার ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। এখনও মতিউর অধরা। তবে তার অবৈধ সম্পদের খোঁজে তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে দুদক। এখনো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন, আগের মতোই। নিজেকে রক্ষা করতে ইফাতকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করার ন্যায় ঘৃণিত মিথ্যাচার করতেও দ্বিধা করেনি।

প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অবাধ লুণ্ঠন অনাচারের যে চিত্র জনসমক্ষে ক্রমাগত প্রকাশ পাচ্ছে। তাদের বিষয়ে সরকারের উপেক্ষার কারণ কী! কারণ আমরা জানি এই সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনায় এনেছে এবং রেখেছে আমাদের দুই আমলাতন্ত্র এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এটা জলের ন্যায় পরিষ্কার। তাই সরকার আমলাদের বিরুদ্ধে তাদের অপরাধের বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে পক্ষান্তরে ওই অনাচার-দুর্নীতিকেই পক্ষান্তরে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সরকার সংশ্লিষ্টরাও ধোয়া তুলসি পাতা নয়। তাদের অবাধ লুণ্ঠন, দুর্নীতিও আকাশ ছোঁয়া। অর্থাৎ আমাদের শাসকশ্রেণি সম্পূর্ণ রূপে দুর্নীতিতে, লুণ্ঠনে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। কে কাকে আটকাবে! রাষ্ট্র এবং সরকার দুটি আলাদা সত্তা। রাষ্ট্র স্থায়ী কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার ৫ বছর মেয়াদি। জনগণ নির্ধারণ করে কোন দল রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। সেটা নির্বাচনে নির্ধারিত হয়। এটাই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিধি ব্যবস্থা। বাস্তবে আমাদের দেশে ওই ব্যবস্থা কার্যকর নেই বরং উপেক্ষিত। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রে এবং সরকারে অর্থাৎ পুরো শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরে নেই স্বচ্ছতা, নেই জবাবদিহিতা, নেই নিয়ন্ত্রণ। আর কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সবাই তো অভিন্ন পথযাত্রী। সর্ষে ভূত থাকলে তো সর্ষে দিয়ে ভূত ছাড়ানো যায় না। আমাদের শাসকশ্রেণির দশা ঠিক তেমনই। একের পর এক আমলা, পুলিশ, সরকারি দলের রাজনীতিকদের রোমহর্ষক দুর্নীতি, অর্থ লুণ্ঠনের ঘটনা ফাঁস হবে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হৈ চৈ হবে। আরেকটি ঘটনা আগের ঘটনাকে চাপা দিয়ে দেবে। একের পর এক ঘটতে থাকা ঘটনায় আর কত প্রতিক্রিয়ামুখর থাকবে মানুষ এবং গণমাধ্যম! আগে নৈতিক পথে উপার্জন এবং অনৈতিক পথে উপার্জন নিয়ে সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেত। এখন সেটা দেখা যায় না। কে কিভাবে, কোন উপায়ে হঠাৎ সম্পদশালী, বিত্তবান হয়ে উঠলো এ নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। বরং বলা হয় তিনি ভাগ্যবান আল্লাহর ইচ্ছায় এবং আশীর্বাদে তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে।

কাগজের মুদ্রা-টাকার যে রঙ রয়েছে, সেটা আমাদের সকলেরই জানা। পরিমাণ ভেদে টাকার রঙও ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। এই রঙ বৈচিত্র্যপূর্ণ তো বটেই এবং বহু রঙের সমাহারে। টাকাকে দুই পৃথক রঙে বিভক্তিকরণের সামাজিক আচার ছিল এবং আছেও। বর্ণিল রঙের এই টাকাকে আমাদের সমাজে সচরাচর সাদা-কালো দুই পৃথক রঙে চিহ্নিত করার অলিখিত নিয়ম প্রচলিত ছিল এবং রয়েছে। সেটা বহুকাল-যুগ পূর্ব থেকেই। অতীতে সামাজিক মান-মর্যাদার প্রশ্নটিও প্রচলিত টাকার রঙের ওপর নির্ভর করতো। অর্থাৎ ব্যক্তির অর্থ বৈধ না অবৈধ সেটা নির্ধারিত হতো ব্যক্তির অর্থ বা টাকা সাদা না কালো নির্ধারণের ভিত্তিতে। হঠাৎ বিত্তবান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিংবা আয়ের সঙ্গে সম্পদ ও ব্যয়ের অসঙ্গতিতে সামাজিক জীবনে ওই ব্যক্তিকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল সৃষ্টি হতো। জন্ম দিত নানা জল্পনা-কল্পনার।

আমার কৈশোরের একটি ঘটনা স্মরণ করছি। সরকারি উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার কয়লা আমদানি করতো, কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তর নামের সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল। আমদানিকৃত সে কয়লা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বার্জ যোগে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে পরিবহনে বেসরকারি ঠিকাদার নিয়োগ করা হতো। বার্জে করে কয়লা পরিবহনের জনৈক ঠিকাদার আমাদের এলাকায় বসবাস করতেন। হঠাৎ ব্যক্তিটির অস্বাভাবিক আর্থিক উন্নতিতে কৌতূহলী স্থানীয়দের মধ্যে এক প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রমাণ যোগ্য তথ্যের অভাবে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলেনি। সেজন্য অবশ্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। অচিরেই ঠিকাদারের বাড়িতে পুলিশ এসে ঠিকাদারকে ধরে নিয়ে যায়। ঠিক দুইদিন পর কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ঠিকাদার বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু প্রকৃত রহস্য আর চাপা থাকেনি। দ্রুত সেটা পুরো এলাকায় চাউর হয়ে গিয়েছিল। ঠিকাদার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কয়লা পরিবহনের জন্য ১৪টি বার্জে কয়লা ভর্তি করে ঢাকার পরিবর্তে অন্যত্রে কয়লা নামিয়ে পাচার করে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে জানায় কয়লাসহ পরিবহনকৃত ১৪টি বার্জ নদীতে ডুবে গেছে। সরকারি পণ্য তসরুপের অভিযোগে ঠিকাদারকে আটক করে পুলিশ। তবে তার দ্রুত অব্যাহতিতে মজার কথাও প্রচার পেয়েছিল। তার এই অপকীর্তির সঙ্গে সরকারি দফতরের লোকজনও জড়িত ছিল। এমন কি বার্জ ডুবেছে কিনা সেটা তদন্তে সরকারি দফতর যাদের নিয়োগ করেছিল; ঠিকাদার ও সরকারি কয়লা নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা দ্রুত তাদের বখরা দিয়ে সমঝোতা করে ফেলে। পরিশেষে তদন্ত নাটকের যাবনিকা এবং ঠিকাদার বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। তবে ঠিকাদারের প্রতিষ্ঠানকে কয়লা পরিবহনের কাজ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। শাস্তি কেবল এটুকুই তিনি পেয়েছিলেন।

সামাজিক ভাবে এলাকায় তিনি ‘কয়লা চোর’ খ্যাতি কিন্তু লাভ করেন। এমন কি তার সন্তানেরা পর্যন্ত কয়লা চোরের খ্যাতি মাথায় নিয়ে নত মুখে এলাকায় চলাচলে বাধ্য হয়। তাদের একতলা বাড়ি দ্রুত চারতলায় রূপান্তরিত হয়। এবং এলাকায় বাড়ি, জমি-সম্পত্তি কেনায় যেন ঠিকাদারের হিড়িক পড়েছিল। স্থানীয় কাউকে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে আর দালালের শরণাপন্ন হতে হতো না। বিক্রেতা স্বয়ং ঠিকাদারের নিকট হাজির হলেই ন্যায্যমূল্যে বাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করতে পারতো। এতে এলাকায় ঠিকাদারের সম্পত্তির পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সেই পাকিস্তানি আমলে রিক্শাযাত্রী ঠিকাদার-পরিবার রিক্শার পরিবর্তে মাজদা গাড়ি হাঁকায়। অর্থ-বিত্ত, সম্পত্তি বৃদ্ধিতেও কিন্তু সামাজিক মর্যাদা তাদের বৃদ্ধি পায়নি। বরং কয়লা চোরের নামকরণে তাদের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সামাজিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারে মসজিদ-মাদ্রাসায় অঢেল অর্থ প্রদান করে সমাজে নিজেকে মর্যাদাবান রূপে প্রতিষ্ঠার কৌশলী উদ্যোগ ঠিকাদার গ্রহণ করেছিল। এই কৌশলটি তার অপবাদ ঘুচাতে সহায়তা করেছিল বটে, তবে প্রকাশ্যে না হলেও নেপথ্যে ঠিকাদারের কুখ্যাতির গুঞ্জন কিন্তু একেবারে বিলুপ্তি ঘটেনি। সেটা বহুকাল টিকে ছিল।

টাকার রঙ নিয়ে সমাজে এখন আর উচ্চ-বাচ্য কেউ করে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করা হয় মাত্র। শর্তাধীনে সে ক্ষেত্রে পরিত্রাণের সুযোগও করে দেয় স্বয়ং রাষ্ট্রই। আয় বহির্ভূত অর্থকে আয়ভুক্ত বা বৈধতা প্রদান করার সুযোগ দেয়া হয়, রাষ্ট্রকে অর্থদণ্ড প্রদানে। অর্থাৎ কালো টাকাকে সাদায় রূপান্তরিত করার রাষ্ট্রীয় স্বাভাবিক (!) ব্যবস্থাধীনে। তাই এখন টাকার পরিমাণগত রঙই টাকার পার্থক্য নির্ধারণ করে, সাদা-কালোর বিভাজনে নয়। টাকা এখন টাকাই, সে যে উপায়ে অর্জিত হোক না কেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভে বাধাপ্রাপ্ত হয় না। ঘৃণা-ধিক্কারের যোগ্যও থাকে না, বিপরীতে পায় নিষ্কণ্টক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি। এতে করেই সমাজে ও রাষ্ট্রে অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয় কে কত বেশি অনৈতিক পন্থা গ্রহণে অর্থশালী হতে পেরেছে। আমাদের রাষ্ট্রের তথাকথিত সেবকগণ এবং রাজনীতিকরা ওই একই পথের যাত্রী হিসেবে জনগণের উপার্জিত অর্থ হাতিয়ে বিত্তশালী হচ্ছে, বিদেশে অর্থ পাচার করে চলেছে। যতদিন জনগণের সরকার দেশে প্রতিষ্ঠা না পাবে; ততোদিন এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়া থামবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

;

এরভিং গফম্যানের তত্ত্ব ও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪, মো. বজলুর রশিদ

ছবি: বার্তা২৪, মো. বজলুর রশিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

এরভিং গফম্যান ছিলেন একজন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, যিনি সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং ব্যক্তিগত পরিচয় নিয়ে কাজ করেছেন।

তার সবচেয়ে বিখ্যাত তত্ত্ব হলো ড্রামাটার্জি বা নাটকীয় উপস্থাপনা তত্ত্ব, যা তিনি তার বই দ্য প্রেজেন্টেশন অব সেলফ ইন এভরি ডে লাইফ-এ বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।

গফম্যানের মতে, সামাজিক জীবন একটি নাটকের মঞ্চের মতো। প্রত্যেক ব্যক্তি একজন অভিনেতা এবং সমাজ একটি মঞ্চ। মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং এই পরিস্থিতিগুলোতে তারা বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেন।

গফম্যান এই তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে মানুষ তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব উপস্থাপন করেন। ড্রামাটার্জি'র মূল ধারণাটি হলো- সামাজিক উপস্থাপনা

এরভিং গফম্যানের 'ড্রামাটার্জি' তত্ত্বে মূল ধারণাটি হলো- সামাজিক উপস্থাপনা



একজন ব্যক্তি কীভাবে তার পরিচয় এবং ব্যক্তিত্ব অন্যদের কাছে উপস্থাপন করেন, সেটাই গফম্যানের মূল আলোচনার বিষয়। তিনি বলেন, যখন মানুষ অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া (Interaction) করেন, তখন তারা দুটি প্রধান এলাকায় থাকেন- সামনের মঞ্চ (front stage) এবং পেছনের মঞ্চ (back stage)।

সামনের মঞ্চে, মানুষ তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন করেন এবং তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্বকে অন্যদের কাছে উপস্থাপন করেন। এখানে তারা তাদের সেরা দিকগুলো প্রদর্শন করেন এবং একটি নির্দিষ্ট ইমেজ বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। পেছনের মঞ্চে, মানুষ তাদের আসল সত্তা প্রকাশ করেন এবং তাদের আসল ‘ব্যক্তিত্ব’ দেখা যায়। এখানে তারা আরেকটু স্বাভাবিক এবং অপ্রতিষ্ঠিতভাবে আচরণ করেন।

গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং মানব আচরণের অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার কাজ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষ নিজেদের উপস্থাপন করেন এবং কীভাবে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার (Social Interaction) মাধ্যমে তাদের পরিচয় গঠন করেন।

এরভিং গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্ব এবং সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তার তত্ত্বটি আজকের ডিজিটাল যুগেও কতটা প্রাসঙ্গিক! সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম, যেমন- ‘ফেসবুক’, ‘ইনস্টাগ্রাম’, ‘টুইটার’ (এক্স) এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম আধুনিক সমাজে মানুষের আচরণ এবং নিজস্ব পরিচয়ের উপস্থাপনা নিয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্বের প্রধান ধারণা হলো- সামাজিক জীবনে মানুষ নিজেকে এক ধরনের অভিনয়শিল্পী হিসেবে উপস্থাপন করেন। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে এই উপস্থাপনাটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সামনের মঞ্চ
বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে, ব্যবহারকারীরা তাদের প্রোফাইল তৈরি করেন, ছবি পোস্ট করেন, স্ট্যাটাস আপডেট করেন এবং বিভিন্ন পোস্ট শেয়ার করেন। এই সবকিছুই গফম্যানের ‘সামনের মঞ্চ’ ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে মানুষ তাদের সেরা দিকগুলো তুলে ধরেন এবং একটি নির্দিষ্ট ইমেজ বজায় রাখার চেষ্টা করেন।

সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ নিজেদের জীবনের সুখকর মুহূর্তগুলো বেশি শেয়ার করেন, যা তাদের পরিচয়ের একটি পছন্দনীয় এবং আকর্ষণীয় দিক প্রকাশ করে। তারা বিভিন্ন ফিল্টার এবং এডিটিং টুল ব্যবহার করে নিজেদের ছবি এবং ভিডিওগুলো আরো সুন্দর করে তোলেন, যা বাস্তব জীবনের চেয়ে কিছুটা আলাদা হতে পারে। এইভাবে, তারা একটি নিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পিত পরিচয় উপস্থাপন করেন, যা তাদের অনুসারী এবং বন্ধুবান্ধবদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়।

পেছনের মঞ্চ
গফম্যানের পেছনের মঞ্চ ধারণাও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক। অনেক সময় মানুষ তাদের প্রাইভেট মেসেজিং (ব্যক্তিগত বার্তা) বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ব্যক্তিগত চ্যাটের মাধ্যমে তাদের আসল চিন্তা এবং অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন। এখানে তারা আরেকটু স্বাভাবিক এবং কম নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকেন, যেটি পেছনের মঞ্চের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

অভিনয় ও আত্মপ্রতারণা
ড্রামাটার্জি তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘অভিনয়’ এবং ‘আত্মপ্রতারণা’। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ অনেক সময় নিজেদের জীবনকে অন্যদের চোখে আরো আকর্ষণীয় এবং সফল দেখানোর চেষ্টা করেন, যা বাস্তবতার সঙ্গে মিল নাও থাকতে পারে। তারা একটি নির্দিষ্ট সামাজিক ইমেজ বজায় রাখতে চেষ্টা করেন, যা অনেক সময় তাদের আসল অবস্থার চেয়ে ভিন্ন হতে পারে।

গফম্যানের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা
সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে গফম্যানের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা আমাদেরকে এই ডিজিটাল যুগে ‘মানব আচরণ’ এবং ‘সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার জটিলতা’ বুঝতে সাহায্য করে। এটি বোঝায় যে, মানুষ কীভাবে তাদের অনলাইন উপস্থিতি তৈরি করেন এবং কীভাবে তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেদের পরিচয় এবং ব্যক্তিত্ব উপস্থাপন করেন।

ড্রামাটার্জি তত্ত্বের সমালোচনা
এরভিং গফম্যানের ড্রামাটার্জি তত্ত্ব ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হলেও এর কিছু সমালোচনাও রয়েছে। সমালোচকেরা বিভিন্ন দিক থেকে এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা এবং অস্পষ্ট দিকগুলো তুলে ধরেছেন।

প্রথমত, গফম্যানের তত্ত্বটি অতিরিক্তভাবে পারফরম্যান্স বা অভিনয়-কেন্দ্রিক। এটি মানুষের প্রতিদিনের ‘জীবনের জটিলতা’ এবং ‘গভীরতা’কে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হতে পারে। সামাজিক জীবনকে শুধুমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। কারণ, মানুষের আচরণ এবং ব্যক্তিত্ব অনেক বেশি জটিল এবং বহুমুখী। এছাড়া, প্রত্যেক ব্যক্তি সর্বদা সচেতনভাবে তাদের আচরণ এবং পরিচয় পরিচালনা করেন না। অনেক সময় মানুষ ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ ও ‘অসচেতনভাবে’ কাজ করেন, যা গফম্যানের তত্ত্বে পর্যাপ্ত গুরুত্ব পায় না।

দ্বিতীয়ত, গফম্যানের তত্ত্বে সামাজিক কাঠামো এবং ক্ষমতা সম্পর্কের বিশ্লেষণ কিছুটা অনুপস্থিত। এটি সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলিকে পর্যাপ্তভাবে বিবেচনা করে না, যা মানুষের আচরণ এবং পরিচয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে, এই বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যেখানে ক্ষমতা এবং সামাজিক কাঠামো উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।

তৃতীয়ত, গফম্যানের তত্ত্বে সাধারণ মানুষের জীবনের সাধারণ বিষয়গুলো অবহেলিত হতে পারে। তিনি প্রধানত ‘নাটকীয়’ এবং ‘বিশেষ পরিস্থিতিগুলো’ নিয়ে কাজ করেছেন, যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বিষয়গুলোকে প্রতিফলিত করে না।

চতুর্থত, এই তত্ত্বটি আধুনিক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল যুগের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই নয়। যদিও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের প্রেক্ষিতে ‘ড্রামাটার্জি’ তত্ত্ব অনেকাংশে প্রাসঙ্গিক, তবে আধুনিক প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল মিথস্ক্রিয়ার জটিলতা সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য এটি পর্যাপ্ত নয়।

গফম্যানের তত্ত্ব ‘সমাজবিজ্ঞান’ এবং ‘মানব আচরণ’-এর অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে এর সীমাবদ্ধতা এবং সমালোচনাগুলোও বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা ‘মানুষের আচরণ’ এবং ‘সামাজিক মিথস্ক্রিয়া’ সম্পর্কে আরো গভীর এবং সুসঙ্গত ধারণা পেতে পারি।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

;

সিলেটে বন্যা এখন বড় আতঙ্কের নাম



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
সিলেটে বন্যা এখন বড় আতঙ্কের নাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

সিলেটে বন্যা এখন বড় আতঙ্কের নাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

এতদিন মনে করা হতো বড় বড় নদী যেমন পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ইত্যাদি বিধৌত এলাকায় শুধু নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোতে ভয়াবহ বন্যা হয়। কিন্তু সেই ধারণা ভুল। কয়েক বছর যাবৎ পাহাড়ি এলাকার খরস্রোতা নদীগুলোতে হঠাৎ এবং অকাল বন্যা হবার সংখ্যা বেড়ে গেছে। এখন পাহাড়ি উঁচু এলাকাতে এবং সিলেট ও চট্টগ্রাম শহরে ঘন ঘন ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে। গত ২০২২ সালে সিলেট বিভাগে চৈত্রমাসে হাওড়ে ঢলের পর বৈশাখে সিলেট নগরেও বন্যার পানির প্রবল স্রোতে শুরু হওয়ায় জনমনে নানা আশঙ্কার চিন্তা শুরু হয়েছিল। এবছর (২০২৪) সিলেট বিভাগের গ্রাম-শহর মিলে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

সাধারণত: সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম হয়ে থাকে। কিন্তু এবছর মে ২৬ থেকে জুনের ১৬ তারিখ পর্যন্ত মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে দুইবার পাহাড়িঢল ও প্রবল বন্যায় ব্যাপক ফসলহানির পর নগরের রাজপথে ও আবাসিক এলাকায় এত বন্যার পানি দেখে মানুষ বেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঢলের পানিতে চোখের পলকেই ভেসে যাচ্ছে জমির ফসল, ডুবে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি। জুনের ২০ তারিখ পর্যন্ত সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ১২৩টি ওয়ার্ড এবং বিভাগের বিভিন্ন জেলার মোট ১৫৬৮টি গ্রাম ডুবে গেছে। রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে বন্যাক্রান্তদের। সুনামগঞ্জের মানুষ আনেকটা দিশেহারা হয়ে আশ্রয়শিবিরে চলে যাচ্ছেন।

বিগত ২০২২ সালে আসামের চেরাপুঞ্জিতে ২০৪ মি:মি: বৃষ্টিপাত এবং সুনামগঞ্জের পাশে মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় খাসিয়া বসতিতে অবিরাম বর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। সেটা ১২২ বছরের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ভেঙেছিল। এছাড়া জকিগঞ্জ দিয়ে উজানে আসামের অতিবৃষ্টির পানি বরাক নদী দিয়ে সুরমা-কুশিয়ারায় নেমে এলেও তারা তা ধারণ করতে পারেনি। এবছর চেরাপুঞ্জিতে ৬০০-১০০০ মি:মি: বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। আসামের বিভিন্ন জেলায় ১৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সেখানকার অতিরিক্ত পানি ফুল ফেঁপে নিচে বাংলাদেশের দিকে দ্রুতগতিতে ধাবিত হওয়ায় সুরমা-কুশিয়ারা ছাড়াও সারি, মনু, ধলাই নদীগুলোর কেউই সেই পানিকে ধারণ করে সময়মত মেঘনায় ফেলতে পারেনি। পানির উচ্চতার চাপে-স্রোতের তোড়ে সবকিছু ছাড়িয়ে পানির কলকল শব্দ ছুটছে শহর-বন্দর, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে নিম্নাঞ্চলের দিকে।

এর ফলস্বরুপ সিলেট অঞ্চলে ঘটছে প্রবল বন্যা। থামছে না উজানের ঢলের পানির স্রোত। সেই সংগে বানভাসি মানুষের কষ্ট ও কান্নার আওয়াজ শুরু হয়েছে। ভাসছে সিলেট শহর, সিলেট বিভাগের সিংহভাগ এলাকা টানা বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। চা-বাগানের পাশে পাহাড়ের পাদদেশে শুরু হয়েছে পুন:পুন কান্নার আওয়াজ।

অনবরত উজানের পানির স্রোত আসছেই। গত সাত দিনেও বন্যার কোনো উন্নতি হয়নি, বরং এলাকায় পানির উচ্চতা বেড়েছে। সিলেট নগরীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।

গত ৬ মে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার কাজে অংশ নেয়ার জন্য সিলেটে গিয়েছিলাম। শাহজালাল উপশহরের অভিজাত এলাকায় আমার একজন প্রাক্তন ছাত্র ও কলিগের বাসা। সেখানে এক গেট-টুগেদারে কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির সংগে সিলেটের বর্তমান আবাসিক পরিবেশ নিয়ে কথা হচ্ছিল। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় বলছিলেন উপশহর আবাসিক এলাকা বেশ সাজানো-গুছানো। কিন্তু ২০২২ সালের পর থেকে বর্তমানে আমরা সবসময় বন্যাতঙ্কে থাকি। একটু বৃষ্টি হলেই এখানকার রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়।

বিশেষ করে উপশহর তৈরি হয়েছে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার জমি ভরাট করে। এই এলাকার বৃষ্টির পানি সুরমা নদীতে ঠিকমতো গড়িয়ে যেতে না পারলে সবার আগে উপশহরবাসীরা বন্যাক্রান্ত হয়ে পড়ে। আমরা ভয়ে থাকি কখন সীমান্তের ওপাড় থেকে ঢল নামে। মেঘালয় ও আসামে ভারী বৃষ্টিস্নাত হলে তার দু’ একদিন পরে আমাদের প্রিয় শহরে পানি ঢুকে যায়। উজানে অতিবৃষ্টির খবর শুনলে উপশহরের বিভিন্ন ভবনের নিচতলাবাসীরা রাতে ঘুমানোর সময় চিন্তা করেন সকালে ডুবন্ত ঘর থেকে ঠিকমতো মালামাল বের করতে পারবেন তো? একমাস না পেরুতেই সে আশঙ্কা সত্যি হয়ে গেছে!

সিলেটের এই অস্বাভাবিক রেকর্ডব্রেকিং বন্যার কারণগুলো বহুমুখী এবং সেগুলো নীতিনির্ধারকদের কাছে মোটেই অজানা নয়। প্রাকৃতিক কারণে উজানের পাহাড়ে অতিবৃষ্টি একটি নিয়মিত ঘটনা। কারণ, আসামের চেরাপুঞ্জিতে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত ঘটে সেটা শিশুকালে আমরাও স্কুলের বইয়ের তথ্য থেকে জানতে পেরেছিলাম। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলে সেই পানি সুরমা-কুশিয়ারার গভীর স্রোতের মধ্য দিয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র মেঘনা হয়ে বঙ্গপোসাগরে চলে যেত। তাই আগেকার দিনে মানুষ বন্যার কথা নিয়ে বেশি একটা ভাবতো না। আজকাল প্রাকৃতিক অতিবৃষ্টি ছাড়াও উন্নয়নের ডামাডোলে ভেসে গেছে চারদিক।

হাওড়ের বুক চিঁড়ে রাস্তা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন সিলেটে ঘন ঘন বন্যার কারণ নেত্রকোনার ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কের কারণে উজানের পানি স্বাভাবিকভাবে ভাটিতে গড়াতে না পারা। মেঘালয়ের পানি হাওড়ে এসে জমা হয়ে দ্রুত নদী দিয়ে নামতে পারে না। ফলে সিলেট পর্যন্ত গড়িয়ে গ্রাম-শহর ভেসে যায়। সিলেটের সুরমা নদী বৃষ্টি, বন্যা ও ঢলের পানির চাপ সহ্য করতে অপারগ। সেই অনুযায়ী পানি নিষ্কাষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখেনি। অধিকিন্তু শহরের নিকটস্থ প্রাকৃতিক জলাধার, লেক, বিল-ঝিল, পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সুনামগঞ্জের হাওড়ে অনেকগুলো পকেট রোড তৈরি করা হয়েছে। সিলেট শহর সংলগ্ন প্রাকৃতিক রিজার্ভার নেই, প্লাবনভূমি নেই। উপশহর বানানো হয়েছে নিচু প্লাবনভূমি ভরাট করে।

পাশাপাশি সিলেটের ড্রেনেজ সিস্টেম অনেকটা সংকুচিত করে নতুনভাবে রাস্তা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। অপরদিকে সিলেটের উজানে আসাম ও মেঘালয়ের বিভিন্ন জেলায় উন্নয়নকাজের জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা, অফিস, বাঁধ ও বাড়িঘর নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। গতবছর সিকিমের বাঁধভাঙ্গা বন্যার সময় দেখা গেছে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ করে রাস্তা তৈরিতে ব্যাপকভাবে বালু, পাথর গড়িয়ে তিস্তা নদীতে পড়ে নাব্য নষ্ট করে তলদেশ ভরাট করে দিয়েছিল। একইভাবে উজানের বালু, কাদামাটি, উন্নয়ন কাজের ডেবরিজ এসে সিলেট এলাকার সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, সারি ইত্যাদি নদীর তলদেশ ভরাট করে তুলেছে।

সেদিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। এসব নদী ঠিকমতো ড্রেজিং করা হয়নি। ফলে উজানে আতিবৃষ্টি বা একটু ভারী বৃষ্টিপাত হলে সেই পানি নদী ধারণ করতে পারছে না। শহরের অগভীর ও সংকুচিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পাশের অগভীর নদী মিলে খুব সহজেই বন্যার পানি দুই কূল ছেপে জনবসতিতে ঢুকে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করে তুলছে প্রতিবছর, বিভিন্ন মাসে বার বার। এটাই গত কয়েক বছর যাবত সিলেটবাসীর চরম নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এতদিনে সুরমার দুই তীরে একটি উঁচু বাঁধও নির্মিত হয়নি, দখলদারদেরকে সরানো যায়নি। প্রতিবছর ঢল শুরু হলে বিপদের আশঙ্কায় অসহায় মানুষ বাঁশ, বালি, কাদামাটির ডালি নিয়ে অসহায়ের মতো বাঁধ রক্ষার্থে ছুটাছটি শুরু করে। কৃষাণীরা দল বেধে তাদেরকে সহায়তা করতে এসে কিছু না পেরে আর্তনাদ করতে থাকে। এদৃশ্য কি আমরা প্রতিবছর বোরো মৌসুমে টিভিতে করুণভাবে প্রত্যক্ষ করে যেতেই থাকব? এজন্য কংক্রীটের ঢালাই দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের ।

হিমালয়ের ভাটিতে অবস্থান করায় উজানের পানির তোড় সামাল দেয়া আমাদের নিয়তি। বন্যা, অকাল বন্যা, ‘ফ্লাশফ্লাড’ ইত্যাদি প্রতিরোধের জন্য আমাদেরকে আগাম সতর্কবার্তা নিয়ে কৃষিপরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে। বিশেষ করে দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত নদীগুলোর ব্যাপারে ডেল্টা প্লানে অতিজরুরি ভিত্তিতে খরা মৌসুমে সেচ ও হঠাৎ পাহাড়ি ঢলের নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ধারা ও সতর্কতা সংযুক্ত করতে হবে। কারণ ভাবতে হবে বন্যা মানেই আমাদের খাদ্যশস্য নষ্ট ও খাদ্য ঘাটতি। কৃষির উন্নয়নই আমাদের প্রকৃত উন্নয়ন কিন্তু প্রতিবছর বার বার বন্যার আক্রমণ আমাদের কৃিষ ও কৃষকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।

প্রতিবছর কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর আমাদের কর্তৃপক্ষের তোড়জোর শুরু হয়। কিন্তু আমরা সময় থাকতে সেসব ব্যবস্থা নিতে ঢিলেমী করি কেন? সরকারী সম্পদের অপচয় রোধ করতে সময়ের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেটা করতে না পারায় দেশের অন্যান্য প্রকল্পের মতো দুর্নীতির বেড়াজালে বন্দী হয়ে থাকবে হাওড়ের সর্বশান্ত প্রান্তিক চাষীদের ফিবছরের বোবা কান্না। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওড় ছাড়া সারা দেশের কৃষি ও কৃষকদেরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গভীরভাবে ভাবতে হবে।

পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর প্রভৃতি বন্যাপ্রবণ শহরগুলোকে ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এসব শহরের চতুর্দিকে যথপোযুক্ত শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। সেগুলোর ভৌত কাজ শীতের শুরুতেই আরম্ভ করে বর্ষা মৌসুম আসার পূর্বে সমাপ্ত করার জন্য তৎপরতা চালাতে হবে। কারণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাজে আমাদের চিরায়ত ঢিলেমি এবং যারপরনাই উদাসীনতা প্রতিবছর বন্যার ক্ষয়ক্ষতিকে আরো বেশি উস্কে দেবার নামান্তর মাত্র। পুন:পুন বন্যা ও ভয়াবহ নদীভাঙ্গন থেকে কৃষি অর্থনীতিকে বাঁচাতে না পারলে দেশের সামগ্রীক উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আসাম ও শিলং-এর অতিবৃষ্টি যখন বার বার সিলেটেবাসীর কান্না হয়ে ফিরে আসে তখন এই বিভীষিকা রোধ করতে সুরমা-কুশিয়ারাকে একটি নতুন পরিকল্পনায় খনন ও দুই পাড় সংস্কারে যুক্ত করে দ্রুত বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয়া উচিত।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

;

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের বিবর্তন



ড. মতিউর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গ্রামীণ বাংলাদেশ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায়ের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। শতাব্দী ধরে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো এই অঞ্চলগুলিতে নেতৃত্বের ধারণাকে গড়ে তুলেছে।

তবে গত কয়েক দশকে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ বাংলাদেশে নেতৃত্বের ধারণাও বিবর্তিত হয়েছে।

ঔপনিবেশিক শাসন এবং নেতৃত্বের বিবর্তন
ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামীণ নেতৃত্ব ছিল জমিদার, ধর্মীয়প্রধান, গ্রামপ্রধান এবং শিল্পীদের মতো সম্মানিত ব্যক্তিদের হাতে। এই ব্যক্তিরা তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং সম্পদের ভিত্তিতে সম্প্রদায়ের দিকনির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।

ঔপনিবেশিক শাসন এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দল, সরকারি কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। এছাড়াও শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বাজার অর্থনীতির উত্থান নতুন নতুন নেতৃত্বের ধারণার জন্ম দেয়।

আজকের দিনে গ্রামীণ বাংলাদেশে নেতৃত্ব আরো বৈচিত্র্যময় এবং বহুমুখী। নারী, যুবক এবং উদ্যোক্তারা ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এই পরিবর্তনগুলি ঐতিহ্যবাহী কাঠামোর সঙ্গে নতুন ধারণার সংমিশ্রণ তৈরি করেছে। এতে করে গ্রামীণ বাংলাদেশের সমাজ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় নতুন নতুন গতিশীলতা দেখা দিচ্ছে।

ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ বাংলাদেশ ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা, যেখানে সামাজিক নেতৃত্ব গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। এই নেতৃত্ব ব্যবস্থা ছিল শ্রেণীবদ্ধ, জমিদার এবং ধনী কৃষকদের মতো স্থানীয় অভিজাত শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল।

এই নেতারা যাদের প্রায়শই ‘গ্রাম প্রধান’ বলা হতো, তাদের সম্প্রদায়ের ওপর উল্লেখযোগ্য কর্তৃত্ব ছিল। তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। এর মধ্যে রয়েছে- গ্রামের অভ্যন্তরীণ বিরোধ সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা; ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন ও তত্ত্বাবধান করা; গ্রামে শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন বজায় রাখা।

এই নেতাদের কর্তৃত্বের উৎস ছিল বেশ জটিল। তাদের ক্ষমতা প্রায়শই জমির মালিকানা, সম্পদ এবং পারিবারিক বংশের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। স্থানীয় রীতিনীতি ও ঐতিহ্য মেনে চলা তাদের নৈতিক কর্তব্য ছিল এবং সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য ছিলেন।

সামন্ততন্ত্র ও জমিদারি প্রথা
ঔপনিবেশিক যুগ গ্রামীণ বাংলাদেশের নেতৃত্ব কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল। বৃটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, যা ‘জমিদার’ নামক ব্যক্তিদের বিপুল পরিমাণ জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ‘কর’ আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করে।

এই ব্যবস্থার ফলে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি দেখা দিয়েছিল। জমিদাররা অভিজাত শ্রেণীর অংশ হয়ে ওঠে এবং তাদের সম্পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তারা গ্রামের প্রধান নেতা হয়ে ওঠে এবং স্থানীয় প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জমিদাররা প্রায়শই তাদের অধীন কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করতেন এবং তাদের শোষণ করতেন, যার ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।

এই পরিবর্তনগুলি সত্ত্বেও জমিদারি ব্যবস্থা প্রভাবশালী স্থানীয় নেতাদের একটি শ্রেণী তৈরি করেছিল, যারা গ্রামীণ সমাজে নেতৃত্ব প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জমিদাররা প্রায়শই স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতেন এবং গ্রামের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।

ভূমি সংস্কার ও নেতৃত্বের পালাবদল
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মই চিহ্নিত করেনি বরং এটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনাও করেছিল। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল- জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি এবং ভূমি সংস্কারের প্রবর্তন।

ভূমি সংস্কারের লক্ষ্য ছিল ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে জমি পুনর্বণ্টন করা, যা ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতা কাঠামোকে ব্যাহত করে এবং গ্রামীণ এলাকায় ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করে।

ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্য ছিল- গ্রামীণ দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন করা এবং আরো সমতাপূর্ণ সমাজ গঠন করা। যাই হোক, এই প্রক্রিয়াটি অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল। পৃষ্ঠপোষক-গ্রাহক সম্পর্কের অবশিষ্টাংশ এবং স্থানীয় অভিজাতদের প্রভাব গ্রামীণ এলাকায় নতুন নেতৃত্ব গঠনে বাধা সৃষ্টি করে।

এছাড়াও জমি বণ্টনের অসমতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ ভূমি সংস্কার প্রোগ্রামের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। তবুও ভূমি সংস্কার বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল। এটি অনেক কৃষককে জমির মালিকানা দিয়েছিল এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করেছিল। যদিও সম্পূর্ণ সমতা অর্জিত হয়নি। তবে ভূমি সংস্কার বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক শক্তির উন্মেষ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল রাষ্ট্রীয় সীমানা পরিবর্তনই করেনি, বরং দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল রাজনৈতিক দলের উত্থান এবং গ্রামীণ এলাকায় তাদের প্রভাব বৃদ্ধি।

জাতীয় পর্যায়ে স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলিতে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। এই দলগুলি তাদের নিজস্ব ভাবধারা ও নীতি নিয়ে ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে। এই প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলি গ্রামীণ এলাকায় তাদের ভিত্তি শক্তিশালী করতে মনোযোগ দিতে শুরু করে। তারা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে জোট গঠন করে দলীয় শাখা প্রতিষ্ঠা করে এবং নির্বাচনে প্রার্থী দেয়।

এই প্রক্রিয়াটি গ্রামীণ নেতৃত্বের রাজনীতিকরণের দিকে পরিচালিত করে। স্থানীয় নেতারা, যারা আগে সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রভাবের ভিত্তিতে ক্ষমতা ধরে রাখতেন, তাদের এখন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়েছিল, তাদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখার জন্য।

এই পরিবর্তনটির বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। প্রথমত, এটি গ্রামীণ এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করে। দ্বিতীয়ত, এটি স্থানীয় নেতাদের ক্ষমতা আরো প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলে। তৃতীয়ত, এটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর রাজনৈতিক দলের প্রভাব বৃদ্ধি করে।

গ্রামীণ নেতৃত্বের রাজনীতিকরণের কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ছিল। কিছু ক্ষেত্রে এটি স্থানীয় স্তরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বৃদ্ধি করে। অন্যান্য ক্ষেত্রে এটি গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদও সৃষ্টি করে।

তবুও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল এবং গ্রামীণ নেতৃত্বের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সম্পর্কটি এখনো বিবর্তিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে গ্রামীণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যকে আকার দিতে থাকবে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) উদ্ভব ও পরিবর্তন
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়।

‘ব্র্যাক’, ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ এবং ‘প্রশিকা’র মতো সংস্থাগুলি দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী পদ্ধতির পথিকৃৎ ছিল। এইসব বেসরকারি সংস্থা কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানই করেনি বরং নেতৃত্বের নতুন ধারারও প্রবর্তন করেছিল, যা সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ, তৃণমূল সংহতি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছিল।

এনজিও-কর্মীরা প্রায়শই স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন, তাদের চাহিদা (Demand) বোঝা এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী সমস্যা সমাধানে (Problem-solving) সহায়তা করার জন্য। এটি এমন নেতাদের উত্থানকে উৎসাহিত করেছিল, যারা তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তাদের উন্নতিতে কাজ করেছিলেন।

এনজিওগুলি নারীর ক্ষমতায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারা নারীদের অর্থনৈতিক সুযোগ প্রদান করেছিল। তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে সমর্থন করেছিল এবং পরিবারে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে উত্সাহিত করেছিল। এর ফলে গ্রামীণ বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

এনজিওগুলির অবদান সত্ত্বেও তাদের সমালোচনাও রয়েছে। কিছু লোক যুক্তি দিয়েছেন যে, এনজিওগুলি খুব বেশি আন্তর্জাতিক তহবিলের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যা তাদের স্থানীয় চাহিদার প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল হতে বাধা দেয়। অন্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, এনজিওগুলি কখনো কখনো ‘অতিরিক্ত শক্তিশালী’ হয়ে উঠতে পারে এবং ‘স্থানীয় সরকার’ ও ‘প্রতিষ্ঠান’গুলিকে দুর্বল করতে পারে।

তবুও সন্দেহ নেই যে, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়নে এনজিওগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

ঐতিহ্যগত ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে কাজ করে এনজিও নেতারা গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদের চাহিদা বোঝার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। তাদের নেতৃত্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্ষমতায়ন এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেন।

‘অংশগ্রহণমূলক’ পদ্ধতির প্রচার এবং ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের’ প্রক্রিয়ায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, এনজিওগুলি তাদের সম্প্রদায়ের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংবেদনশীল নেতাদের একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি করেছে।

গ্রামীণ নেতৃত্বে এনজিওগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেওয়া। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে এনজিওগুলি নারীদের তাদের পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছে।

নারী-নেতৃত্বাধীন স্বসহায়ক গোষ্ঠী এবং সমবায়গুলি সম্মিলিত পদক্ষেপ এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে, ঐতিহ্যগত লিঙ্গ নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে এবং গ্রামীণ নেতৃত্বের পরিধি প্রসারিত করেছে।

এছাড়াও ‘বিকেন্দ্রীকরণ সংস্কার’ বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। এই সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য ছিল- ‘স্থানীয় স্তরে শাসনকে শক্তিশালী করা’ এবং ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা’।

বিকেন্দ্রীকরণ সংস্কার গ্রামীণ এলাকায় নতুন নতুন নেতাদের উত্থানকে উৎসাহিত করেছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধিরা প্রায়শই স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি হন। এই নেতারা তাদের সম্প্রদায়ের চাহিদা ও উদ্বেগের প্রতি সাড়া দিতে সক্ষম এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নারী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেয়। স্থানীয় কাউন্সিলে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন অন্তর্ভুক্ত করা লিঙ্গ-অন্তর্ভুক্ত নেতৃত্বের দিকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

ইউনিয়ন পরিষদের নারী নেতৃবৃন্দ আঞ্চলিক সমস্যা যেমন স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক কল্যাণ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

গ্রামীণ বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি আধুনিকায়ন, রেমিট্যান্স এবং অকৃষি কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলি সামাজিক নেতৃত্বের ধরনকেও প্রভাবিত করেছে।

‘সবুজ বিপ্লব’, ‘উচ্চ ফলনশীল’ ফসলের জাত এবং ‘আধুনিক চাষাবাদের কৌশল’ প্রবর্তনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে অনেক কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এই সফল কৃষকেরা প্রায়শই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের পথিকৃৎ, তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ নেতৃত্ব, যা প্রায়শই জমির মালিক, ধর্মীয় নেতা বা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তা ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। নতুন ধনী কৃষকেরা তাদের অর্থনৈতিক শক্তি এবং উদ্যোক্তা মানসিকতার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করছেন। তারা স্থানীয় সরকার, সামাজিক সংস্থা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

পোশাকশিল্প ও জনশক্তি রফতানি
পোশাক শিল্পের উত্থান এবং বিদেশে শ্রম রফতানি গ্রামীণ বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং নেতৃত্বের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। পোশাকশিল্প এবং বিদেশে শ্রম রফতানি গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে।

রেমিট্যান্স, অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ, গ্রামীণ এলাকায় স্কুল, রাস্তা, বিদ্যুৎ এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মতো অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়েছে। রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত পরিবারগুলি প্রায়শই ব্যবসা শুরু করতে বা কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে অর্থ ব্যবহার করে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরো বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে।

অভিবাসী পরিবারগুলি প্রায়শই তাদের সম্প্রদায়গুলিতে ফিরে এসে অর্জিত সম্পদ এবং অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে। এটি ঐতিহ্যবাহী নেতাদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন ধরনের নেতৃত্বের দিকে পরিচালিত করে। অর্থ এবং প্রভাব অর্জনের মাধ্যমে, অভিবাসী পরিবারগুলি প্রায়শই তাদের সম্প্রদায়গুলিতে উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা অর্জন করে। এটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এবং ক্ষমতার গতিশীলতাকে প্রভাবিত করে।

পোশাকশিল্পে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ তাদের আর্থিক স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। এটি গ্রামীণ সমাজে লিঙ্গের ভূমিকা পরিবর্তনে অবদান রেখেছে। উল্লেখ্য যে, পোশাকশিল্প এবং বিদেশে শ্রম রফতানির কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিকদের শোষণ, পরিবেশগত ক্ষতি এবং পারিবারিক ও সামাজিক বিচ্ছেদ।

গ্রামীণ এলাকায় অকৃষি কার্যকলাপের বৃদ্ধি, যেমন ছোট ব্যবসা, বাণিজ্য এবং পরিষেবা, আয়ের উৎস এবং নেতৃত্বের ধরনকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। এই প্রবণতাটি কৃষিকাজের ওপর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী নির্ভরতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।

অকৃষি কাজ গ্রামীণ এলাকায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, যা পারিবারিক আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাস করে। বিভিন্ন ধরনের অকৃষি কার্যকলাপের উপস্থিতি গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরো স্থিতিশীল করে তোলে এবং বাজারের ঝুঁকির প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অকৃষি ব্যবসা প্রায়শই স্থানীয় অবকাঠামো, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে অবদান রাখে।

উদ্যোক্তা এবং ব্যবসার মালিকেরা, যারা কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেন এবং স্থানীয় উন্নয়নে অবদান রাখেন, তারা গ্রামীণ সম্প্রদায়ের নতুন নেতা হয়ে উঠছেন। এই নতুন নেতাদের নেতৃত্ব প্রায়শই উদ্ভাবন, ঝুঁকিগ্রহণ এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ওপর ফোকাস করা হয়। ঐতিহ্যবাহী নেতারা, যারা প্রায়শই জমির মালিকানা বা সামাজিক মর্যাদার ওপর ভিত্তি করে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখেন, তাদের প্রভাব কমতে পারে।

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের পরিবর্তনে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং সাক্ষরতার হার এবং শিক্ষায় প্রবেশাধিকার উন্নত করার উদ্যোগ নতুন প্রজন্মের নেতাদের ক্ষমতায়িত করেছে। জ্ঞান এবং দক্ষতাসহ শিক্ষিত তরুণেরা তাদের সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করছেন।

গ্রামীণ এলাকায় যুব নেতৃত্ব ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক পরিবর্তন, উদ্ভাবন এবং সম্প্রদায় পরিষেবার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তরুণ নেতারা তাদের সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছেন।

গ্রামীণ বাংলাদেশে, সামাজিক নেতৃত্বে তরুণদের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতার গতিশীলতা বিন্যাস করছে এবং উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এই তরুণ নেতারা প্রায়শই উদ্ভাবনী চেতনা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রবল আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত, গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।

শিক্ষাগত অগ্রগতি, অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি এবং এনজিও ও সুশীল সমাজ সংস্থার প্রচেষ্টার সমন্বয়ে গ্রামীণ এলাকায় নারী নেতৃত্বের উত্থান ঘটেছে। এর মূলে রয়েছে, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যেমন, মেয়েদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেন, যা তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে।

ক্ষুদ্রঋণ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং স্বসহায়ক গোষ্ঠীতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। এর ফলে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে তাদের কণ্ঠস্বর আরো শক্তিশালী হয়। এসব প্রতিষ্ঠান নারীদের নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা নারীদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।

নারী নেতৃত্ব গ্রামীণ পরিবার ও সম্প্রদায়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারীরা শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নতিতেও অবদান রাখেন এবং স্থানীয় সরকারে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন।

এই অগ্রগতি সত্ত্বেও, অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক নিয়ম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা এবং সম্পদে সীমিত প্রবেশাধিকার নেতৃত্বে নারীদের পূর্ণ অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার জন্য এবং লিঙ্গ সমতাকে উন্নীত করার জন্য শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সুযোগগুলিতে নারীদের প্রবেশাধিকার বাড়ানো এবং নারীদের নেতৃত্বের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক নেতৃত্ব ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন নেতারা। ঐতিহ্যবাহী নেতৃত্বের ধরন থেকে শুরু করে নারী, তরুণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নতুন নেতৃত্বের উত্থান পর্যন্ত, আমরা বৈচিত্র্যময় নেতৃত্বের বিকাশ দেখেছি।

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের জন্য, আধুনিক আকাঙ্ক্ষা ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব
একদিকে, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্বের গুরুত্বের ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি রয়েছে। অন্যদিকে, গভীরভাবে উপবিষ্ট সাংস্কৃতিক নিয়ম এবং পরিবর্তনের প্রতিরোধ অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতায়ন একটি অপরিহার্য চ্যালেঞ্জ। নেতাদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং জটিল উন্নয়ন সমস্যা মোকাবিলায় তাদের সক্ষম করার জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এটি অর্জন করা যেতে পারে। উপরোন্তু, দৃঢ় ও জবাবদিহিমূলক স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সামাজিক নেতৃত্বের অগ্রগতি ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রামীণ নেতৃত্বে তথ্যপ্রযুক্তি এবং ডিজিটাল সংযোগের প্রভাব

গ্রামীণ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ, তথ্যপ্রাপ্তি এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি নেতাদের ক্ষমতায়ন করতে পারে। তবে ডিজিটাল বিভাজন বিদ্যমান বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে, কারণ সবার প্রযুক্তির সমান অ্যাক্সেস (প্রবেশাধিকার) নেই। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং প্রযুক্তির সম্ভাব্য সুবিধাগুলি সর্বাধিক করা গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক নেতৃত্ব দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিবর্তিত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী শ্রেণিবদ্ধ কাঠামো থেকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার দিকে এই পরিবর্তনগুলি নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রতিফলন ঘটায়।

বাংলাদেশ উন্নয়নের জটিল পথে এগিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক নেতৃত্বের ভূমিকা অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেশের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এবং পরিবর্তনশীল সামাজিক প্রেক্ষাপটে, টেকসই ও প্রাণবন্ত গ্রামীণ সম্প্রদায় গড়ে তোলার জন্য স্থানীয় নেতাদের ক্ষমতায়ন, লিঙ্গসমতা এবং তরুণদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

গ্রামীণ বাংলাদেশের সামাজিক নেতৃত্বের ক্রমবর্ধমান বিবর্তন কেবল একটি পরিবর্তনশীল সমাজেরই প্রতিফলন নয় বরং এটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা ও গতিশীলতার প্রমাণ। ঐতিহ্যবাহী কাঠামো থেকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির দিকে এই ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন রূপান্তর, অভিযোজন এবং অগ্রগতির একটি অনুপ্রেরণামূলক গল্প বলে।

এই বিবর্তনের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তাদের নিরলস পরিশ্রম এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতিই গ্রামীণ এলাকায় ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নে অবদান রেখেছে।

যদিও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তবুও এখনো অনেক কিছু করার আছে। নতুন চ্যালেঞ্জের উত্থান এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সামাজিক নেতৃত্বের ভূমিকাকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

গ্রামীণ বাংলাদেশে সামাজিক নেতৃত্বের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। সঠিক পদক্ষেপ এবং সমর্থনের মাধ্যমে, আমরা এমন নেতাদের বিকাশ করতে পারি, যারা তাদের সম্প্রদায়কে ন্যায়বিচার, সমৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই প্রচেষ্টায় সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন - সরকার, বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, স্থানীয় সম্প্রদায় এবং ব্যক্তি। একসঙ্গে কাজ করে আমরা একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনতে পারি।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী, ইমেইল: [email protected]

;