সরকার জাতির ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একটি করে সংস্কার কমিশন গঠন করার আদেশ জারি করেছে। দীর্ঘদিনের পুরনো অভ্যাসে আমরা কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হালকাভাবে বলার এক ভুল সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি। তা হলো এই যে, এই দেশ এবং এর পূর্বসূরি পাকিস্তান ও তার পূর্বসূরি অবিভক্ত ভারত শাসনের মূল আইনগুলোকে পুরনো, জরাজীর্ণ, ঘুণে ধরা এবং উপনিবেশিক ও স্বাধীন দেশের অনুপযোগী বলে সভা, সেমিনার ও লেখায় জনমানুষের কাছে প্রিয় করে তোলা। অথচ তা করতে গিয়ে সাধারণ থেকে বিশিষ্ট সব বুদ্ধিজীবী বা চিন্তক ভুলে যান যে ওই আইনগুলো এমন এক জাতির আইনবিদ ও রাজনীতিদিদের উদ্ভাবন যারা মধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব, বিদ্যুৎ, বাষ্পীয় জাহাজ, রেল ইঞ্জিন, ভূমির ক্যাডের্স্ট্রাল সার্ভে, বিশ্ববিদ্যালয়, বিচার বিভাগ তথা মানুষের জীবন-জীবিকা পরিচালনা করার সব প্রথা ও পদ্ধতি, আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এগুলোর কোনোটি কোটি কোটি মানুষের জীবনে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। পার্শ্ববর্তী বিশাল দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় কিংবা সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় এই আইনগুলো ২৫০-৩০০ বছর পরও প্রায় অপরিবর্তনীয়ভাবে সচল রয়েছে। কাজেই অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দেশ বাংলাদেশেও সেগুলো জনজীবনে ও জীবিকায় কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করার যুক্তি নেই।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তাই যখন সরকার, রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সমন্বয়করা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছেন, তা করার আগে একটু যাচাই করে দেখা দরকার যে, এর প্রয়োজন কতটা গভীরে প্রোত্থিত। এটা ঠিক, কালের পরিবর্তনে নবসৃষ্টি, নববিধান এবং নবচাহিদার প্রয়োজন অনুভূত হতে পারে। কিন্তু তা প্রবর্তন করার আগে এটাও যাচাই করা দরকার যে, পুরনো পদ্ধতিতে কোথায় কোন মৌলিক অসুবিধা বা বাধা বোধ হচ্ছে। আসলে ১৯৪৭ সাল থেকে এ বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, পাকিস্তানের প্রথম শাসকরাই একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ৯ বছর সময় লাগিয়ে এবং দুই বছর পর তা খারিজ করে দিয়ে ব্রিটিশ প্রণীত চমৎকার ব্যবস্থার ক্ষতিসাধন আরম্ভ করেন। তা কোটি কোটি মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শুধু শাসক, সশস্ত্র বাহিনী এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের স্বার্থে কাজ করে। এই তিন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত মানুষের সমষ্টি ছিল মুষ্টিমেয়। ফলে কোটি কোটি সাধারণ জনগণ জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
ভোট, শাসনতন্ত্র, রাজনৈতিক সরকার তথা ব্রিটিশদের প্রণীত জনসম্মতির ভিত্তিগুলো নষ্ট করে শাসকরা যে সামরিক আইনের মাধ্যমে দেশ শাসন করে এবং জনগণ ও শাসকের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য সৃষ্টি করে তার ফলেই ১৯৬৯ সালে স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের পরিবর্তন ঘটে ১৯৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনের ফলাফল নতুন সামরিক শাসক কর্তৃক আবার অস্বীকৃত হলে পাকিস্তান ভেঙে দু-টুকরো হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এক কথায় এর মূল কারণ ব্রিটিশদের প্রণীত তথাকথিক উপনিবেশিক, পুরনো ও ঘুণে ধরা ব্যবস্থাকে শাসকদল কর্তৃক বিভিন্ন সময় বিকৃত ও স্থগিত করা। ১৯৭২ থেকে ২০২৪ এর জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বিভিন্ন শাসক বাংলাদেশে একই ধারা অব্যাহত রাখেন। এরই সর্বশেষ পর্যায়ে গত আওয়ামী লীগ সরকার জনরোষের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর কারণও সেই ব্রিটিশ মডেলে প্রণীত ১৯৭২-এর শাসনতন্ত্র এবং বিচারব্যবস্থাকে নানাভাবে অচল, অকার্যকর, স্থগিত, সুপ্ত করে নিজেদের ইচ্ছেমাফিক শাসনতন্ত্রবিরোধী আইন ও প্রথা প্রণয়ন করে দেশ শাসন করা। কাজেই একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে, যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে তা আসলে খুব কিছু মৌলিক পরিবর্তন নয়। বরং ৭৭ বছরের পথপরিক্রমায় শাসনের আইনসমূহে ইচ্ছাকৃত যে পরিবর্তন করা হয়েছে, সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমেই এই সংস্কার সম্ভব। এই সূত্রে আমি ছয়টি কমিশনের বিষয়গুলোকে না এনে একটি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সংস্কার সম্পর্কে কিছু প্রস্তাব পেশ করার চেষ্টা করছি।
দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে পুলিশ অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। পুলিশ বাহিনী যদি তাদের জন্য প্রযোজ্য আইনসমূহ দিয়ে পরিচালিত হয় তাহলে অপরাধীর শাস্তিবিধান হয়ে সমাজে এমন শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে যে, সমাজের অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে আর তেমন কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হবে না। পুলিশের কার্যাবলি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল-১৯৪৩’, ‘সিআরপিসি-১৮৯৮’, ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড আপিল রুলস’ ও ‘কন্ডাক্ট রুলস’গুলো ব্রিটিশদেরই প্রণীত। সিআরপিসিতে পুলিশ জনশৃঙ্খলাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও বলবৎ করবে সে বিষয়ে অনুচ্ছেদভিত্তিক বিস্তারিত নির্দেশনাবলি রয়েছে। অপরাধের সঙ্গে সন্দেহ করা যায় এমন কোনো ব্যক্তিকে কীভাবে আটক, গ্রেপ্তার, জিজ্ঞাসাবাদ করবে এবং সে সম্পর্কে তদন্ত করে অভিযোগ বিবরণী প্রস্তুত করে তা আদালতে পেশ করার মাধ্যমে আনীত অভিযোগসংবলিত মামলার বিচার কাজে ভূমিকা পালন করবে তা পরিষ্কারভাবে বর্ণিত আছে। জনসমাবেশ এ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য কীভাবে প্রয়োজনে কোন পদ্ধতিতে বলপ্রয়োগ, গুলিবর্ষণ ইত্যাদি করবে তার পদ্ধতিও সিআরপিসি এবং পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল-এ লিখিত আছে।
অন্যদিকে পুলিশ তার ব্যক্তিগত আচরণ কীভাবে পরিচালনা করবে তার জন্য রয়েছে কন্ডাক্ট রুলস বা আচরণবিধি। আর চাকরিবিধি ভঙ্গের জন্য তার ওপর কী ধরনের দণ্ড প্রযোজ্য হবে তার জন্য রয়েছে ডিসিপ্লিন ও আপিল রুলস।
সময়ের দীর্ঘ পরিসরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, ওপরের বিধিগুলোর বা এর অংশবিশেষ লঙ্ঘন করার কারণেই পুলিশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের বিচারপ্রত্যাশী লাখ লাখ মানুষের বিভিন্ন অভিযোগ উদ্ভূত হয়েছে।
ওপরে উল্লিখিত আইন এবং অন্যান্য আইনে বিধান যাই থাকুক বা না থাকুক সংস্কারের এই মহালগ্নে পুলিশকে সৎ মানুষদের সেবা আরও কার্যকরভাবে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিচের ব্যবস্থাগুলো প্রবর্তন ও অনুসরণ করার সুপারিশ করছি।
১. সন্দেহভাজন কোনো স্থানে কোনো ব্যক্তি বা মালামাল আটকে অভিযান, ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ, তদন্ত পরিচালনা, গুলিবর্ষণ এবং অভিযোগ বিবরণী মুসাবিদা ও চূড়ান্ত করার প্রতিটি স্তরে পুলিশকে অবশ্যই ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকার নিয়োজিত ফৌজদারি আইনবিদের আদেশ ও অনুমোদন নিতে হবে।
২. জিজ্ঞাসাবাদে সন্দেহভাজনের দেহ স্পর্শ করা যাবে না। তা বর্তমান আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা আছে। সন্দেহভাজনকে একাদিক্রমে কথিত অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যসমূহের পরস্পরবিরোধিতা, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সাক্ষী ও সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের Corroboration-এর মাধ্যমে অপরাধের ভিত্তি নির্ণয় করতে হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেট বা উকিলের সঙ্গ ছাড়া মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাদী, বিবাদী, আসামি, সাক্ষী কিংবা অন্য কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ/কথোপকথন করতে পারবেন না।
৩. বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন প্রণয়নকারী কর্মকর্তা কর্তৃক সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মচারীর এসিআর ফরম প্রতিপাদন করার পর তা প্রতিস্বাক্ষর করবেন ওই এলাকার পরবর্তী উচ্চতর স্তারের প্রশাসনের কর্মকর্তা। এভাবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার এসিআর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের এসিআর ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক, পুলিশ সুপারের এসিআর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক এবং রেঞ্জ ডিআইজির এসিআর ডিভিশনাল কমিশনার কর্তৃক প্রতিস্বাক্ষরিত করতে হবে।
৪. পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত কোনো মামলা বা অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন করবেন উপজেলা/জেলা/বিভাগ/মহানগরের কোনো প্রশাসনের কর্মকর্তা বা ম্যাজিস্ট্রেট। উল্লেখ্য, মেজর সিনহার (অব.) হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন একজন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সম্পন্ন হয়। যার ভিত্তিতে জেলা জজ মামলাটি গ্রহণ করেন।
৫. পুলিশের সব পর্যায়ের নিয়োগের পর প্রশিক্ষণ একাডেমিতে তাদের তাদের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করার শিক্ষা দিতে হবে। তাদের অবশ্যই মনে রাখাতে হবে যে, নির্দিষ্ট সংখ্যক সেবাগ্রহীতার ওপর ভিত্তি করেই পুলিশের বিভিন্ন পদসংখ্যা, পদন্নোতি, মযার্দা এবং বেতনভাতা নির্ণিত। তাদের প্রদত্ত করের অর্থে পুলিশ বেতন-ভাতা পায়। জনগণের মধ্যে যে দুর্বৃত্তের অংশ রয়েছে তাদের সঙ্গে পুলিশের বন্ধুত্বের কোনো প্রয়োজন নেই। আইনমান্যকারী, অন্যায়ের শিকার এবং বিচারপ্রার্থী যে অংশ পুলিশ কেবল তাদেরই বন্ধু হবে।
৬. প্রতিটি থানায় ইলেকট্রনিক ডিসপ্লের মাধ্যমে দায়েরকৃত মামলা তদন্তের অবস্থা, তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার অগ্রগতি, ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান ও বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে প্রেরণের তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ও পদবি মামলা দায়েরকারী বা তার উকিলের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।
৭. কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয়ের অডিট টিম পুলিশ সুপার কার্যালয়ের নিরীক্ষা করার সময় পারফরমেন্স অডিটর হিসেবে মামলা দায়েরের তারিখ থেকে আদালতে প্রেরণের তারিখ পর্যন্ত সময়ের নিরীক্ষা সম্পন্ন করে তা কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করবে।
৮. প্রাক্তন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এ ওয়াই বি ওয়াই সিদ্দিকী প্রস্তাবিত সব পুলিশ কর্মচারীর আয়-ব্যয়ের হিসাব, আয়কর বিভাগের এ-সংক্রান্ত স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের বাইরে, পুলিশ সদর দপ্তর কর্তৃক আবশ্যিকভাবে গ্রহণ ও তার ওপর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এই ব্যবস্থাগুলো বা এর অংশবিশেষ পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনার বিভিন্ন আইন এবং শাসনতন্ত্রের বুনিয়াদি আইনে প্রকাশিত বা নিহিত রয়েছে। কিন্তু অবহেলা এবং ইচ্ছাকৃত পরিবর্তনজনিত কারণে এগুলোর বাস্তবায়ন বা বলবৎ অনেক ক্ষেত্রেই রহিত অবস্থায় আছে। এগুলোর প্রবর্তন এবং পুনঃপ্রবর্তন পুলিশ বিভাগের সৎ কর্মচারীদের উৎসাহিত করবে। অপরদিকে অসৎ কর্মচারীদের আইনের শাসনের ব্যাপারে এবং আইন নিজের হাতে না তুলে নেওয়ার বিষয়ে ভীত রাখবে। ফলে উৎকোচ গ্রহণ, বাদী বা বিবাদীকে হুমকি প্রদান, সাক্ষ্য ও আলামত ধ্বংস বা নষ্ট করা ইত্যাদি কাজে তারা নিরুৎসাহিত হবেন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল
masud.ahmed@hotmail.com
খবরের কাগজ’র সৌজন্যে