আমি বেড়ে উঠেছি ওয়ারিতে। আমার শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের বড় একটা অংশ ওয়ারিতেই কেটেছে। 'মহল্লা কালচার' বলে পুরান ঢাকায় একটা ব্যাপার ছিল। এক মহল্লার সঙ্গে অন্য মহল্লার সমস্যা হতো। সেই সমস্যা মেটানোর জন্যে সালিশ বসত। বয়সে তরুণ হওয়া সত্ত্বেও সে রকম কিছু সালিশে আমার থাকার সুযোগ হতো। কারণ, আমি চটজলদি যুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারতাম। সে রকম একটা সালিশে গোপীবাগ-টিকাটুলি-হাটখোলার প্রভাবশালী সর্দার সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছিল। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সান্ধ্যকালীন জুয়ার আসর 'হাউজি'সহ গরুর হাটের নিয়ন্ত্রণ ছিল খোকা ভাইয়ের হাতে। গোপীবাগ এলাকায় খোকা ভাইয়ের দাপট ছিল প্রবল। প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে সালিসে 'খোকা' ভাইকে এনেছিলেন সানাউল হক খান। কবি।
আমাদের বাড়িটা ছিল হেয়ার স্ট্রিটে। র্যাংকিন স্ট্রিটে কোরবান আলীর বাড়ির একটা অংশে ভাড়া থাকতেন কবি সানাউল হক খান পরিবার। সানাউল ভাইয়ের ঠিক ওপর তলায় থাকত পাপ্পুরা। পাপ্পু আমাদের এলাকাতুতো ছোট ভাই। প্রায়শঃ গ্যাঞ্জাম বাধত সানাউল ভাইয়ের সঙ্গে পাপ্পুদের। সানাউল ভাইয়ের অভিযোগ ছিল, ওপর তলায় বাস করা পাপ্পুদের ফ্যামিলি ইচ্ছে করে কিছু শব্দ করত। শব্দ করে হাঁটা, ফ্লোরের ওপর ভারি কিছু ফেলা কিংবা লাঠি বা শাবল বা লোহার রড দিয়ে অনবরত ঠুক ঠুক শব্দ করার মতো অভিযোগ ছিল প্রাত্যহিক। রাত বারোটার পরেও কোনো কোনো দিন সানাউল ভাই হন্তদন্ত হয়ে আমার ঘরের সামনের রাস্তা থেকে চিৎকার চেঁচামেচি করে আমাকে ডাকতেন। আমাকে তার সঙ্গে যেতে হতো। তারপর একটা মিমাংসা করে তবেই ফিরতে পারতাম।
ঘটনাটা একপর্যায়ে সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করেছিল। সানাউল ভাই বসিয়েছিলেন সালিশ, তার ঘরে। সেই সালিশে আমাকেও থাকতে হয়েছিল। সানাউল ভাই এবং পাপ্পু দু'পক্ষই আমাকে চেয়েছিল। সালিশে খোকা ভাই কিছু ঠাণ্ডা ঝারি দিতে গেলে আমি তাকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমার যুক্তিপূর্ণ কথার প্যাঁচে তিনি নীরব হয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষমেশ আমার কথাকেই সমর্থন দিয়েছিলেন। ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে উভয় পক্ষকেই তিনি বলেছিলেন, এরপর আমাকে আর ডাকবে না। রিটন যা বলবে সেটা আমারও কথা। আর একান্তে আমাকে বলে গিয়েছিলেন, সানাউলকে দেইখ। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম। কারণ মানুষটাকে আমি পছন্দ করতাম।
একাত্তরের অবরুদ্ধ ঢাকার দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার যুদ্ধকালীন কীর্তি আমার জানা ছিল। মেজর খালেদ মোশাররফের বিখ্যাত ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন। খোকার নেতৃত্বে শান্তিনগরের ডিএফপি ভবনটি উড়িয়ে দিয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা। উনিশ শ’ একাত্তরের অক্টোবরের সেই অভিযানটি কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে। ক্র্যাক প্লাটুনের সাহসী যোদ্ধা হিসেবে তার প্রতি আমার আলাদা একটা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ছিল। তিনি বিএনপি করতেন সেটা মানতে যদিও আমার কষ্ট হতো।
সেই সালিশে ক্ষুব্ধ সানাউল ভাই অভিমান করেছিলেন আমার ওপর। কারণ আমি অন্ধের মতো তাকে সমর্থন করিনি সালিশে। তবে খোকা ভাইয়ের অনুরোধটা আমি মনে রেখেছিলাম।
সময় গড়িয়ে যায়। নব্বইয়ের প্রবল আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর আসে নির্বাচন। ১৯৯১ সালের সেই নির্বাচনে আমাদের অঞ্চলের (ওয়ারি-সূত্রাপুর) ক্যান্ডিডেট ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। সেই আসনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিএনপি কাউকে মনোনয়ন দেওয়া মানেই সেই প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা শূন্য। সুতরাং বিএনপি এমন একজন ক্যান্ডিডেট সিলেক্ট করল, যে প্রার্থী হারলেও ক্ষতি নেই। এই ধরনের দুধভাত টাইপের ক্যান্ডিডেট সাব্যস্ত হয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা, শেখ হাসিনার বিপরীতে।
নির্বাচনের দিন সন্ধ্যার আগে আগেই সেই আসনের ভোট গণনা সমাপ্ত হয়েছিল। আমাদের সবাইকে হতবাক করে দিয়ে সেই আসনে সেবার জয়ী হয়েছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। ব্যাপারটা বিস্ময়কর ছিল। খোকা ভাই নিজেও প্রস্তুত ছিলেন না এ রকম একটা জয়ের জন্যে। র্যাংকিন স্ট্রিট মোড়ে সিলভারডেল কিন্ডারগার্টেন ভোটকেন্দ্রের সামনে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবসহ বিষণ্ণ আমি দাঁড়িয়ে আছি। সাদেক হোসেন খোকাকে সামনে নিয়ে একটা আনন্দ মিছিল এগিয়ে আসছিল আমাদের দিকে। মিছিলটা আমাদের অতিক্রম করে যাবার সময় হতভম্ভ খোকা ভাইয়ের দৃষ্টি ছিল মাটির দিকে অবনত। এতোটাই অপ্রস্তুত ছিলেন তিনি তখন যে আমাদের সঙ্গে আই কন্টাক্টেও যেতে পারছিলেন না।
এরপর খোকা যুব-ক্রীড়ামন্ত্রী হলেন। মন্ত্রী হবার পর তার অধঃপতিত হওয়ার গতিটা প্রবল হলো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির কাজটাও করলেন তিনি নির্লজ্জভাবে। একাত্তরে যে ডিএফপি ভবন তিনি উড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে, সেই ডিএফপির সামনে দাঁড়িয়ে টিভি ক্যামেরায় বললেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম।’ অথচ আমরা জানি, ইতিহাস জানে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি জিয়া পাঠ করেছিলেন ২৭ মার্চ বিকেলে। জিয়ার কণ্ঠে প্রথম সেটা প্রচারিত হয়েছিল ২৭ মার্চ বিকেলে। তার আগে নয়। অথচ খোকা দাবি করলেন। খোকা মিথ্যাচার করলেন। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণাটি প্রচারিত হবার দু'দিন আগেই তিনি সেটা শুনেছেন!!
এরপর সময় গড়িয়েছে। খোকা মেয়র হলেন ঢাকার। অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি হলো তার। প্রভাব-বিত্ত যতোই বাড়লো, জ্যামিতিক হারে তিনি নষ্ট হতে থাকলেন।
২
আমরা স্মরণে আনতে পারি, নিকট অতীতে সাতচল্লিশের চেতনায় ফিরে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করে একদল কুলাঙ্গার একজোট হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ০১ ডিসেম্বর বিভিন্ন দৈনিকে ছবিসহ একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরে বলা হয়েছিল, চারদলের নেতাদের সেই বৈঠকে ‘বেগম খালেদা জিয়া এবং এরশাদসহ অংশগ্রহণকারী সবাইকে আতর মাখিয়ে দেন জামায়াতের গোলাম আযম’। সেই বৈঠকেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিরোধী ভয়ংকর ‘চারদলীয় জোট’ আত্মপ্রকাশ করেছিল। সেই বৈঠক থেকেই সাতচল্লিশের চেতনায় ফিরে যাবার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছিল। ভয়াবহ একটা ইউটার্ন নিয়েছিল একত্তরে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ।
‘গোআযমে’র সঙ্গে সেই যে গাঁটছড়া বাধলেন খোকা এবং তার বিএনপি, সেখান থেকে এককালের মুক্তিযোদ্ধা খোকা আর ফিরে আসেননি। বেঈমান হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বেঈমানিটা তিনি করেছেন তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। তিরিশ লাখ শহীদের সঙ্গে।
২০০১-এর নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি চারদলীয় জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে একযোগে প্রচারণায় নেমেছিল। সে বড় দুঃসময় ছিল বাংলাদেশের। অশুভ শক্তির গ্রহণকাল চলছিল তখন। আমরা দেখলাম ঢাকার রাজপথে, মতিঝিল-পল্টন এলাকায় একটা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার পাশে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ এবং একাত্তরের বীর গেরিলা যোদ্ধা খোকা। একাত্তরের ভয়ংকর খুনিগুলোর পাশে হাস্যোজ্জ্বল খোকাকে দেখে একলা একা অশ্রুসজল হয়েছি গোপনে, কতোবার!
(পরে দেখেছি খোকার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন 'বাঘা সিদ্দিকী' খ্যাত কাদের সিদ্দিকীও। যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের পত্রিকা নয়াদিগন্ত এবং দিগন্ত টিভিতে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে চোঙ্গা ফুঁকেছেন অত্যন্ত কদর্য ও নির্লজ্জভাবে!)
আমার মহল্লাতুতো বড় ভাই সাদেক হোসেন খোকার ক্রমঃবর্ধমান অধঃপতনে ক্ষুব্ধ ব্যথিত আমি একটা ছড়া লিখেছিলাম দৈনিক জনকণ্ঠের পাতায় ২০০৬ সালে। ছড়াটার শুরুর অংশটা উদ্ধার করি-
[ বিজয় দিবসে অখ্যাত এক শহীদ জননীর চিঠি--
শহীদ জননী ডেকো না আমাকে, ওতে আমি পাই লজ্জা
এই বাংলার মাটিতে আমার পুত্র পেতেছে শয্যা--
অথচ জানি না সেটা কোনখানে? কোথায় ঘুমালো পুত্র?
দেশের মাটির সঙ্গে আমার রক্তের যোগসূত্র।
গত পঁয়ত্রিশ বছরে বাছারে ঘুমুতে পারি না রাত্রে
ছেলের স্পর্শ-গন্ধটা খুঁজি তার নীল শার্ট হাতড়ে।
খেতে বসলেই মানিকের মুখ ভেসে ওঠে চোখে, আহারে
ও মানিক তুই কোথায় ঘুমালি? জিজ্ঞেস করি কাহারে?
যাকেই শুধাই বলে দেখি নাই, ওরা সব জ্ঞানী বোদ্ধা,
অথচ ওরাই ছিল তোর সাথি, ছিল তোর সহযোদ্ধা।
ওরা কেউ কেউ আজকে জানিস ঘাতকের মহা মিত্র
তিন দশকের মাথায় দেখছি বুক ভেঙে যাওয়া চিত্র--
এক মঞ্চেই বক্তৃতা করে তোদের বন্ধু 'খোকা'রা
ওরা বেঁচে থাকে, মন্ত্রীও হয়, তোরা মরেছিস বোকারা!
তোদের প্রাণের বিনিময়ে ওরা আখের নিয়েছে গুছিয়ে
ওরা কোনোদিন আসে নাই দিতে আমার অশ্রু মুছিয়ে...''
রচনাকাল/ অটোয়া ১৩ ডিসেম্বর ২০০৬
প্রকাশকাল/ দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৭ ডিসেম্বর ২০০৬ ]
(উদ্ধৃতি সূত্র/ছড়াসমস্ত, ২য় খণ্ড, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ২০১০।)
স্মরণে আনতে পারি ফটিকছড়ির ঘটনাটিকে।
২০১৪ সালের দৈনিক জনকণ্ঠ জানাচ্ছে--''নিজস্ব সংবাদদাতা, ফটিকছড়ি, ১০ এপ্রিল ॥
আজ ফটিকছড়ির ভুজপুর হত্যাকাণ্ড দিবস। ২০১৩ সালের এই দিনে এটিএম পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে হরতালবিরোধী শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা বের করে। এ শোভাযাত্রাটি দক্ষিণ ফটিকছড়ি থেকে উত্তর ফটিকছড়ি ভুজপুর-কাজিরহাট বাজার প্রদক্ষিণ করতেই জামায়াত-বিএনপি জঙ্গিরা মসজিদের মাইকে মিথ্যা গুজব রটিয়ে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রার ওপর নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফারুক হোসেন বিপুল, যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ রুবেল ও মোহাম্মদ ফোরকানকে হত্যা করে। এতে প্রায় দু’শতাধিক নেতাকর্মীকে আহত করে এবং তিন শতাধিক মোটরসাইকেল ও যানবাহনে অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়।’
ফটিকছড়ির ঘটনায় হতভম্ব শোকবিহবল হয়েছিল পুরো দেশ। সেই ঘটনার পর একটি জনসভায় ক্রুদ্ধ সাদেক হোসেন খোকা আঙুল উঁচিয়ে বলেছিলেন, 'সমগ্র বাংলাদেশকে ফটিকছড়ি বানানো হবে।' কী ভয়ংকর হুমকি!
অথচ ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণালী দিনগুলো’ নামের স্মৃতিকথায় সাদেক হোসেন খোকা লিখেছিলেন, ‘তিনি (মা) যখন দেখলেন আমাকে ফেরানো যাবে না, তখন বললেন, আমাকে কথা দাও অন্যায়ভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কাউকে হত্যা করতে পারবে না।' মায়ের কথায় রাজি হয়ে আবার ফিরে যাই রণাঙ্গণে।’
আসলে ক্ষমতার মোহ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। বধির করে দেয়।
৩
এরপর কতো কষ্ট আর গ্লানির দিন গেছে আমাদের।
অবশেষ ফের ইউটার্ন নিল ইতিহাসের চাকা। আওয়ামী লীগ এলো রাষ্ট্রক্ষমতায়। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা নানান চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে আমার এককালের প্রিয় খোকা ভাইয়ের নতুন বন্ধুদের টপাটপ ঝুলিয়ে দিলেন ফাঁসির দড়িতে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হলো খোকার নতুন বন্ধুরা--গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, মীর কাসেমরা। কলঙ্কমুক্ত হলো বাংলাদেশ। পাকি দোসর এবং পাকি দোসরদের দোসররা ফেরার হলো। পলাতক হলো। দেশান্তরি হলো। এই দেশান্তরি হওয়াদের তালিকায় যুক্ত হলো সাদেক হোসেন খোকার নামটাও। চিকিৎসার জন্যে তিনি গেলেন আমেরিকায়। নিউয়র্কের বিখ্যাত হাসপাতালে শুরু হলো তার চিকিৎসা। রাজনৈতিক আশ্রয়ও প্রার্থনা করলেন তিনি।
নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আজকালের ০১ নভেম্বর সংখ্যার একটা লিঙ্ক এসেছে আমার কাছে। সেখানে ‘পাসপোর্টের অভাবে লাশও যাবে না দেশে?’ খোকার জীবনের ‘সকাল’ রাতের চেয়েও 'অন্ধকার' শিরোনামে প্রতিবেদক শাহাবউদ্দিন সাগর জানাচ্ছেন,
[...‘ম্যানহাটানের স্লোন ক্যানসার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। চিকিৎসকরা তার বেঁচে থাকার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। আর এরই মধ্যে নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে মৃত্যুর পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বর্ণাঢ্য রাজনীতিকের শেষ ইচ্ছা পূরণ নিয়ে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট না থাকায় তার মরদেহ দেশে পাঠানো যাবে কি না এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় খোকার পরিবার। একই পরিস্থিতির কারণে সাদেক হোসেন খোকার স্ত্রীও যেতে পারবেন না দেশে। এমন চিন্তা করেই সাদেক হোসেন খোকার রাজনীতির সতীর্থ ও নেতাকর্মীরা বারবার বলছেন, যে ব্যক্তি দেশ স্বাধীন করার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন, সেই প্রিয় বাংলাদেশ থেকে তিনি দেশান্তরিত হয়ে আজ সাত সমুদ্র তের নদীর এ পাড়ের আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী। সাদেক হোসেন খোকা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবেন কিন্তু দেশে যাওয়ার অতৃপ্তি নিয়ে। যে দেশের মাটির জন্য তিনি অস্ত্র ধরেছিলেন সেই মাটিতেও হয়তো চিরনিন্দ্রায় যেতে পারবেন না ঢাকাবাসীর এক সময়ের প্রিয় মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। তাই হাসপাতালের লবিতে দাঁড়িয়ে অনেকেই চোখের জল বিসর্জন করে বলছেন, একজন ভালো মানুষের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের সকালটি মনে হচ্ছে ‘রাতের চেয়েও অন্ধকার’।
সাবেক এই মন্ত্রীর সুস্থ হয়ে ওঠার আর কোনো সম্ভাবনা না থাকায় চিকিৎসকরা এরই মধ্যে তার ক্যানসার চিকিৎসায় ক্ষান্ত দিয়েছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্লোন কেটেরিং ক্যানসার সেন্টারের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে সাদেক হোসেন খোকাকে।
...ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের মে মাসে একজন ভিজিটর হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র।
...২০১৭ সালের শেষদিকে তার নিজের এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী স্ত্রী ইসমত হোসেনের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় তারা নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনসুলেটে প্রয়োজনীয় ফি জমা দিয়ে পাসপোর্ট নবায়ন বা নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তাদেরকে পাসপোর্ট না দেয়ায় একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে খোকা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। তার সেই আবেদন এখনো অনিষ্পন্ন। এর মধ্যে দফায় দফায় কনসুলেটে খোঁজ নিয়েও পাসপোর্টের কোনো হদিস মেলেনি। সর্বশেষ মাস ছয়েক আগে স্ত্রী ইসমত হোসেন সশরীরে কনসুলেটে গিয়ে পাসপোর্টের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু তিনি যথারীতিই পাসপোর্টের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেননি। অগত্যা হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।
...বিরতিহীন চিকিৎসার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও গত কয়েক মাস ধরে সাদেক হোসেন খোকা দেশে ফেরার জন্য অনেকটা পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বলতেন, ঢাকায় যাওয়ার পর জেলে যেতে হলে যাব, চিকিৎসার জন্য আর আসতে না দিলেও সমস্যা নাই। দেশে গিয়েই মরব। কিন্তু পাসপোর্ট ছাড়া দেশে যাব কি করে?
...কাকতালীয়ভাবে খোকার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের ওপর যেদিন ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেয়ার তারিখ সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর। গাড়িতে চড়ে ইমিগ্রেশন অফিসে যাওয়ার সময় পুরোটা পথ নীরবে চোখের পানি ঝরিয়েছেন খোকা। একপর্যায়ে পাশে বসে থাকা স্ত্রীকে বললেন, ‘আজ বাংলাদেশের বিজয় দিবস। যুদ্ধ করে এইদিনে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ সেই বিজয় দিবসেই যাচ্ছি অন্য দেশে আশ্রয় চাইতে!’]
প্রিয় খোকা ভাই,
এই প্রতিবেদন পাঠ করে একটুও ব্যথিত হইনি আমি। কারণ, নিজেদের গড়া অলিখিত ঘৃণ্য অমানবিক নিয়মেরই শিকার হয়েছেন আপনি। নাথিং এলস্! বিরুদ্ধমতের মানুষকে পাসপোর্টবিহীন নাগরিকে রূপান্তরের ইতিহাস আপনারাই রচনা করেছিলেন।
২০০১-এর নভেম্বরে আপনারা জামায়াত-বিএনপি চারদলীয় জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর থেকে আমি দেশান্তরি ছিলাম। বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা-বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং ঘাতক-রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে লেখালেখির অপরাধে অতি নগন্য আমার পাসপোর্টটি বাতিল করা হয়েছিল। নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের সবুজ একটি পাসপোর্ট আমারও প্রাপ্য ছিল। আবেদনও করেছিলাম যথারীতি, কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাসে।
২০০২ থেকে টানা সাত বছর আমি অপেক্ষা করেছি। মাসের পর মাস বছরের পর বছর আমি ছুটে গিয়েছি দূতাবাসে। কিন্তু আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে প্রাপ্য পাসপোর্ট থেকে। গত কয়েক মাস ধরে দেশে ফেরার জন্য আপনি যেমন অনেকটা পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলেন, আমার অবস্থাও তো তেমনই ছিল! আপনার মতো আমিও পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম দেশে ফেরার জন্যে। গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছি প্রবাসে নিজের ঘরে। কিন্তু আপনার সরকার আমার প্রতি সামান্য দয়াও দেখায়নি। আমি দেশে ফিরতে পারিনি।
মঈন-ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭-এর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে অবশেষে আমি আমার কাঙ্ক্ষিত সবুজ পাসপোর্টি পেয়েছিলাম। আপনি অনেক ভাগ্যবান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনার দেশে ফেরার ব্যবস্থা নিতে বলে দিয়েছিলেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করিৎকর্মা মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম তড়িৎব্যবস্থাও নিয়েছিলেন।
কিন্তু ফুরিয়ে গিয়েছে আপনার সময়। বিশেষ ট্রাভেল ডকুমেন্টে আপনি ফিরে যাচ্ছেন বাংলাদেশে। কফিনবন্দি আপনাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। জীবন বাজি রেখে যে দেশটাকে একদা স্বাধীন করেছিলেন আপনি, সেই দেশের মাটিতে আপনার পরবর্তী জীবনের সহযোদ্ধা নিজামী-মুজাহিদ-কামরুজ্জামান-মীর কাসেম-কাদের মোল্লা-গোলাম আযমদের ঠাঁইও হয়েছে। ওদের মতো কুলাঙ্গারদের ঠাঁই হলে আপনার কেন হবে না! দুঃখ আমার একটাই, ক্র্যাক প্লাটুনের একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হয়েও শেষ জীবনে আপনিও ছিলেন সেই কুলাঙ্গারদেরই দোসর! ক্ষমতার মোহের কাছে পরাজিত আপনার এক জীবনের শ্রেষ্ঠ গৌরবের সমস্ত সৌরভকে ইতিহাস মুছে দিয়েছিল তার নিষ্ঠুর ইরেজারে!
আপনি যদিও বেঁচেই ছিলেন আমাদের কালে। কিন্তু আমার কাছে আপনি ছিলেন মৃত। এই যে এখন, আপনি মরে গেলেন, আপনার জন্যে আমার কাছে শোকপুষ্প নেই কোনো। কোনো শোকবাণীও অবশিষ্ট নেই আর। কেন না, যেদিন আপনি ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন হাস্যমুখে ঘাতক গোলাম আযমের সঙ্গে, যেদিন আপনি সংগ্রাম শুরু করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, সেদিনই আপনি মরে গিয়েছিলেন আমার কাছে। আপনার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছিলাম সেদিনই। শুকিয়ে যাওয়া আমার অদৃশ্য পুষ্পাঞ্জলিটা সেদিনই রেখে এসেছিলাম আপনার পদযুগলে, একাত্তরের ভয়াল রক্তাক্ত দিনগুলো স্মরণে!
(লুৎফর রহমান রিটন-এর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া)
লুৎফর রহমান রিটন: ছড়াকার, লেখক