জঙ্গিদের মাথায় আইএস টুপি, কিসের ইঙ্গিত?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মুফতি এনায়েতুল্লাহ | 2023-08-30 23:28:03

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলখানার গেটে ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ নীতিবাক্যটি লেখা থাকে। কারাগারকে মূলত একটি সংশোধনাগার হিসেবে পরিণত করতে এমন পদক্ষেপ। এছাড়া কারাগারে থাকার সুবাদে অনেকেই অনুশোচনায় ভুগে জীবনে পরিবর্তন ঘটান। তাই তো বলা হয়, কারাগারে গেলে মানুষের মনে পরিবর্তন আসে। তার কিছুটা প্রমাণ মেলে আসামিদের পোশাক-পরিচ্ছদে। এ পরিবর্তনের ফলে দেখা যায়, দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা আসামির মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি, গায়ে পাঞ্জাবি। এটা নিয়ে কখনও কথা হয়নি। এবার কথা হচ্ছে আসামির মাথায় দেওয়া বিশেষ একটি টুপিকে কেন্দ্র করে।

বুধবার (২৭ নভেম্বর) বহুল আলোচিত হলি আর্টিজান মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পর প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে নেওয়ার সময় জঙ্গিদের কয়েকজনের মাথায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট)-এর মনোগ্রাম সম্বলিত কালো টুপি দেখা গেছে। দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকা জঙ্গিদের কাছে আইএসের লোগো সম্বলিত টুপি কীভাবে এলো এটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

ঘটনাটি একাধারে বিস্ময়কর এবং ভয়ঙ্কর প্রশ্নবোধক। সাধারণ টুপি হলে কথা ছিলো না, কথা হচ্ছে টুপিটি বিশেষ চিহ্নবোধক বলে। এই টুপি যে কেউ বানাতে সক্ষম নন। কারণ, এখানে আরবিতে লিখতে বা আঁকতে হয় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’ আমাদের দেশের প্রচুর মানুষ আরবি পড়তে জানলেও লিখতে জানেন খুব কম সংখ্যক লোক। সেখানে নির্দিষ্ট রংয়ের, ফন্টের লোগো বানানো বা আঁকা কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। এই আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে কারা হেফাজতে ছিলেন। এমতাবস্থায় তাদের কাছে এই বিশেষ টুপি কীভাবে এলো?

আসামির মাথায় আইএস লোগো সম্বলিত টুপি

বাংলাদেশে ইতোপূর্বে অনেক জঙ্গি মামলার রায় হয়েছে। রায় ঘোষণার পর প্রায় সময়ই দেখা গেছে, আসামিরা ‘ভি চিহ্ন’ দেখাচ্ছে, কিংবা এজলাসে অথবা আদালতে আনা-নেওয়ার পথে ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবির দিচ্ছে। হলি আর্টিজান মামলার ক্ষেত্রেও আসামিদের কেউ কেউ ‘এ রায় মানি না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছে, আল্লাহু আকবার, আমি জড়িত ছিলাম না, আমরা বিজয়ী, আল্লাহ আকবর, মৃত্যুদণ্ডের রায়ে আমরা ভীত নই, ভবিষ্যতে এরচেয়ে বড় ঘটনা ঘটাবো’ বলে নানা স্লোগান ও বক্তব্য দিয়েছেন। এর সবগুলোই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইএসএর মনোগ্রাম সম্বলিত টুপি পড়ার বিষয়টিতে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যাচ্ছে না।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে এটা স্পষ্টভাবে এসেছে, আদালতে আনার সময় কারও মাথায় এমন টুপি ছিল না। বের হওয়ার সময় এই টুপি দেখা যায়। কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আনা জঙ্গিরা আইএসের প্রতীক সংবলিত টুপি কোথায় পেলেন তা নিয়ে উপস্থিত সবার মধ্যে বিস্ময় ও প্রশ্ন তৈরি হয়। এরা কারাগার থেকে এ টুপি নিয়ে এসেছেন নাকি আদালতে আনার সময় বা আনার পর কোনোভাবে তাদের কাছে এই টুপি এসেছে- এটা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘এটি আমরা দেখেছি, ছবিও দেখেছি। আমরা বিস্মিত। কারাগার থেকে আনার সময় আসামিদের তল্লাশি করে দেখা হয়, তাদের সঙ্গে কী আছে তা দেখা হয়। এ ধরনের টুপি তাদের কাছে কীভাবে গেল, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হবে।’

প্রিজন ভ্যান থেকে আসামির হুঙ্কার কিসের ইঙ্গিত?

এই টুপি প্রসঙ্গে দুপুরে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘এটি নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। আমি এখনই তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব।’

সঙ্গতকারণে প্রশ্ন উঠেছে-

এক. কারান্তরীণ আসামিদের কাছে এ ধরনের টুপি কীভাবে পৌঁছল? কারা এর ব্যবস্থা করেছে? আগেই বলা হয়েছে, যে কেউ এই টুপি বানানোর ক্ষমতা রাখেন না।

দুই. যদি কারাগার থেকে বের করার পরে তার কাছে এই টুপি পৌঁছায়, তাহলে প্রশ্ন থাকে- কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তারা কঠোর পুলিশী প্রহরায় ছিল। এত কড়া পুলিশী ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার প্রহরাধীন থাকার পরও তাদের কাছে কীভাবে এই টুপি পৌঁছাতে পারল এবং কারা পৌঁছালো?

তিন. যেভাবেই তার কাছে এই টুপি পৌঁছানো হোক, পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর উপস্থিতিতে এই টুপি পরে সে কীভাবে অবস্থান করল?

চার. এই টুপি পরিহিত অবস্থায় তাদেরকে কেন প্রকাশ্যে ও মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হলো? এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি সমাজের ও উঠতি জঙ্গিদের মাঝে যে ভয়ানক নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে সে বিষয়টি সম্পর্কে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা কি ওয়াকিবহাল নন? নাকি এ বিষয়ে তারা উদাসীন?

পাঁচ. এমনও তো হতে পারে, কেউ বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে তাদেরকে এভাবেই উপস্থাপন করতে চেয়েছে? তারা কারা ও কেন? তাদের স্বার্থ কী?

হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। এ ঘটনা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ থেকে শুরু করে প্রায় সব দেশের মানুষের নজর ছিল এ মামলার রায়ের প্রতি। এমতাবস্থায় এদিনই এই টুপি মাথায় আসামিদের রণহুংকার সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

আইনমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট একাধিক বিভাগ থেকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানানো হয়েছে। আশা করি, দ্রুততম সময়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে এ বিষয়টি তদন্ত করা হবে। প্রকৃত ঘটনা জনগণকে জানানো হবে এবং কোনো প্রকার ধামাচাপা দেওয়া হবে না।

আরেকটি কথা, ইসলামে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদসহ দেশ ও মানবতাবিরোধী সব কাজ হারাম। এ বিষয়ে সব আলেমরা একমত। ইসলাম এসেছে সব শ্রেণির, সব মানুষের শান্তি ও মুক্তির জন্য। অশান্তি সৃষ্টিকারী মুসলিম-অমুসলিম যেই হোক তাকে দমন করা ইসলামের নির্দেশ। কোনো পোশাক, লেবাস ও ধর্ম তাকে কোনো অন্যায় কাজ করতে উৎসাহ দেয় না, সমর্থন করে না।

টুপি মুসলমানদের একটি নিদর্শন, ইসলামি পোশাক। টুপি পরিধান করা সুন্নত। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন ও তাবে তাবেয়িনের যুগ থেকে প্রতি যুগে এর ওপর ব্যাপকভাবে আমল ছিল, এখনও আছে। সেটাকে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে, বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর চিহ্ন বা প্রতীক বানানোর অনুমতি ইসলাম দেয় না।

 

মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তা২৪.কম

Read: IS cap on the head of the militants- what it indicates?

এ সম্পর্কিত আরও খবর