মাস্ক ধুয়ে দিয়েছেন…

, যুক্তিতর্ক

আমীন আল রশীদ | 2023-08-28 17:54:03

সোশ্যাল মিডিয়ায় মাঝেমধ্যে এমন সব জিনিস ভাইরাল হয় যেগুলো দেখে হাসি পেলেও সেই ঘটনাগুলো চলমান সময়ের কিছু রূঢ় বাস্তবতাও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অনেক সময় সেগুলো একধরনের পরিহাসও মনে হয়।

সম্প্রতি রাস্তায় বের হওয়া নিয়ে কিছু মানুষের মন্তব্য:

১. টেলিভিশনের রিপোর্টার ভিড়ের ভেতরে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বাইরে বেরিয়েছেন, বাজারে এসেছেন, কিন্তু মুখে মাস্ক নেই কেন? ভদ্রলোকের নির্ভার ও নির্লিপ্ত জবাব, ‘মাস্ক ধুয়ে দিছি।’ অর্থাৎ যে মাস্কটি তিনি ব্যবহার করেন, সেটি ধুয়ে শুকোতে দিয়েছেন। অতএব এখন মাস্ক ছাড়াই বের হয়েছেন।

২. সাংবাদিক আরেকজনকে একই প্রশ্ন করলেন যে, আপনি বাইরে বেরিয়েছেন, কিন্তু মাস্ক তো পরেননি। জবাবে তিনি বলেন, ‘বাসায় রেখে আসছি’। অর্থাৎ মাস্ক বাসায় রেখে আসার জিনিস।

৩. একজন নারীকে একই প্রশ্ন করা হলো যে আপনি মাস্ক ছাড়া বের হয়েছেন কেন? কিছুটা লজ্জা পেয়ে তিনি সাথে সাথে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে মাস্কের কাজ সারেন।

৪. ঈদের আগে শর্তসাপেক্ষে যখন পোশাকের দোকান ও মার্কেট খোলা হলো, তখন একটি টেলিভিশনের সাংবাদিক একজন ক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলেন, এরকম মহামারির ভেতরে শপিং করা কি খুব জরুরি? উত্তরে তিনি বলেন, ‘সামান্য এক ভাইরাসের কারণে কি শপিং বন্ধ হয়ে যাবে?’

৫. করোনার ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ যখন প্রিয়জনের সাথে ঈদ করতে ঢাকা ছাড়লেন, তখন ফেরিঘাটে এক ভদ্রলোক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘স্ত্রী ফোন করেছে, বলেছে মরলে একসাথেই মরব, বাড়ি আসো। তাই বাড়ি যাচ্ছি।’

এই হলো করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের জনসচেতনতার মাত্রা। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভেবে নির্ভার থাকার সুযোগ নেই। কারণ আপনি আপনার বাসার আশপাশে তাকালে দেখবেন, প্রতিদিন করোনায় মৃত্যু এবং শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও মানুষের ওই অর্থে ভয়ডর খুবই কম।

বুধবার (২৭ মে) সকালে রাজধানীর গ্রিনরোড এলাকায় গ্রিন সুপার মার্কেটের সামনের ফুটপাতে একাধিক চায়ের স্টল ঘিরে মানুষের যে জটলা দেখা গেছে, তাতে যে কারোর মনে হবে, দেশে করোনাভাইরাস নামে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই। দেদারসে মানুষ আড্ডা দিচ্ছে এবং অধিকাংশের মুখেই মাস্ক নেই। মানুষ কীভাবে এরকম একটি ভয়াবহ ভাইরাসের সময়ে—যখন এই ভাইরাস সারা বিশ্বকে অচল করে দিয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান-ক্ষমতা আর অর্থবিত্তে অগ্রসর দেশগুলোয় লাখ লাখ মানুষ বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছে; সারা পৃথিবীর সকল শক্তি এই অণুজীবের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে—তখন বাংলাদেশের মানুষ কী করে এতটা নির্ভার, নির্লিপ্ত, নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে, সেটি এক বিরাট গবেষণার বিষয়। মাস্ক বা স্বাস্থ্যবিধি এবং শারীরিক দূরত্ব নিয়ে মানুষের যে উদাসীনতা, সেই উদাসীন হওয়ার শক্তি তারা কোথায় পায়, সেটিও ভাবনার খোরাক যোগায়।

মানুষের এই নির্ভরতা আর উদাসীনতার ভেতরেই লকডাউন উঠে যাচ্ছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন বলা হয়নি। বলা হয়েছে সাধারণ ছুটি। সেই সাধারণ ছুটিও ৩০ মে’র পরে আর বাড়ছে না বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে শেষ হবে সপ্তম দফার ছুটি। গত ২৬ মার্চ থেকে সাত দফায় (২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল, ৪ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল, ৯ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল, ১৪ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল, ২৫ এপ্রিল থেকে ৫ মে, ৫ মে থেকে ১৬ মে এবং ১৬ মে থেকে ৩০ মে) সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার।

এই দফায় আর ছুটি বাড়ছে না মানে হলো ৩১ মে থেকে অফিস-আদালতসহ সব ধরনের কর্মক্ষেত্র চালু হবে। যদিও এ বিষয়ে সরকার কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে। যেমন অফিস চালু হলেও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে; অফিসে বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীরা যাবেন না; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে ১৫ জুন পর্যন্ত এবং সাধারণ ছুটি না বাড়লেও এবং অফিস আদালত খুললেও গণপরিবহন চলবে সীমিত আকারে। 

প্রথমে বলা হয়েছিল গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। কিন্তু এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র সমালোচনা শুরুর পর সরকারের তরফে সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচলের কথাও জানানো হয়। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, গণপরিবহনে কতজন যাত্রী চলবে, তা ঠিক করবে স্থানীয় প্রশাসন।

এখানে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে:

১. অফিস আদালত চালুর সাথে সীমিত আকারে গণপরিবহন চালু হবে। কিন্তু বাংলাদেশে গণপরিবহনের যে সংকট এবং তার যে ব্যবস্থাপনা, সেখানে সীমিত আকারে চালু বলতে সেই সংখ্যাটি কত, তা স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে রাজধানীতে যে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাসগুলো যাত্রী পরিবহন করে, সীমিত আকারে হলে কোন কোন কোম্পানির বাস চলবে, কোন রুটে কতটি চলবে—তা কি সরকার ঠিক করে দেবে? পরিবহন খাতে যে ধরনের মাফিয়াদের রাজত্ব, তাতে এই খাতের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকবে? সীমিত আকারে বলা হলেও গণহারে যে বাস নামবে না এবং বাসগুলো যে আগের মতোই গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করবে না, সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে? সবার ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। সবার পক্ষে রিকশা বা সিএনপি অটোরিকশায় প্রতিদিন যাতায়াত করা সম্ভব হবে না। আবার একসাথে অনেক লোক কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বেরো হলে সামান্য সংখ্যক রিকশা ও অটোরিকশা কিংবা রাইড শেয়ারের মোটর বাইক সে চাহিদা মেটাতে পারবে না। এক-দুই কিলোমিটার দূরত্বে যাদের কর্মস্থল, তারা হয়তো হেঁটে যাতায়াত করতে পারবেন। কিন্তু সবার এই সুযোগ থাকবে না। সরকারি ও বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো নিজেদের কর্মীদের সুরক্ষা ও সুবিধার কথা বিবেচনা করে নিজস্ব পরিবহনের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু বাকিদের কী অবস্থা হবে? তাদের ভরসা তো ওই গণপরিবহন। তাদের সুরক্ষার উপায় কী?

২. বলা হচ্ছে, রাস্তায় এবং কর্মস্থলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। যে দেশের মানুষ মাস্ক না পরে বের হয়ে ক্যামেরার সামনে অকপটে বলে যে ‘মাস্ক ধুয়ে দিয়েছি’ কিংবা ‘ঘরে রেখে এসেছি’ অথবা শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে মাস্কের কাজ সারেন, সেই দেশে কতজন লোক কর্মস্থলের ভেতরে এবং যাওয়া-আসার পথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন? করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধির প্রথম ও প্রধান শর্তই হলো মাস্ক পরা। সেই মাস্ক পরিধানেই মানুষের যে উদাসীনতা, সেখানে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধির যে কী দশা হবে, তা সহজেই অনুমেয়।

৩. বলা হচ্ছে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। প্রশ্ন হলো ১৭ কোটি লোকের দেশে যেখানে রাস্তায় বের হলে মানুষের গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগে—সেই দেশে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার তরিকা কী? ধরা যাক অফিস আদালতে সহকর্মীরা অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে বসবেন; অফিসের ভেতরেও না হয় মাস্ক পরে থাকবেন এবং কারো সামনে গিয়ে হাঁচি কাশি দেবেন না—কিন্তু কয়টা অফিসে বা কারখানায় এই দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে?

৪. ১৫ জুন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কোনো মিরাকল ছাড়া ১৫ জুনের পরে দেশ থেকে করোনাভাইরাস উধাও হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং ১৬ জুন থেকে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়, সেখানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল কী হবে? বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থীরা কী করবে? তারা অনেক দিন পরে বন্ধুদের দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে একজন আরেকজনকে হয়তো জড়িয়ে ধরবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের পক্ষে কোমলমতি শিশুদের শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে? নাকি শিশুদের ক্লাস এখনই খুলবে না। যদি না খোলে তাহলে কতদিন বন্ধ থাকবে? এই যে মাসের পর মাস শিশুদের স্কুল বন্ধ এবং অধিকাংশেরই বাসায় পড়ালেখা হচ্ছে না (আমার মেয়ে নার্সারিতে পড়ে, সেই অভিজ্ঞতায় বলছি), এই ক্ষতি কী করে পেষানো যাবে? এই ছোট শিশুদের অনলাইনে পাঠদান সম্ভব হবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার যদিও ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ শিরোনামে সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস এবং ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও ক্লাস আপলোড করছে। সেইসাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ঘরে বসে শিখি’ শিরোনামে সংসদ টেলিভিশনে ভিডিও ক্লাস চলছে। কিন্তু এগুলো কতটা কার্যকর এবং এভাবে আসলে পড়ালেখা কতটা হচ্ছে, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই।

৫. মরলে স্বামী-স্ত্রী একসাথে মরব—এই মনোভাব নিয়ে যেসব লোক ঈদ করতে ঢাকার বাইরে গিয়েছেন, ছুটির পরে তারা সবাই তো আবার একইভাবে গাদাগাদি করে ঢাকায় ফিরবেন। এই যাওয়া-আসার পথে যারা করোনায় আক্রান্ত হলেন, তারা আরও কতজনকে আক্রান্ত করেছন এবং করবেন? মহান সৃষ্টিকর্তা সহায় না হলে হঠাৎ করে যদি বিপুল সংখ্যক মানুষ অসুস্থ হতে থাকেন, সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কোনো কৌশল আমাদের জানা আছে?

৬. অনেকেই যে কথা বলবেন বা স্বাস্থ্যমন্ত্রীও যে কথা বলেছেন যে, ইউরোপ আমেরিকার তুলনায় আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতি এখনও ভালো। এ কথার সত্যতা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু পরিস্থিতি তো দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকলে এবং নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আমাদের অবস্থা যে ইতালি বা নিউইয়র্কের মতো হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?

বাস্তবতা হলো, করোনার বিপদ খুব দ্রুত আমাদের মাথার ওপর থেকে বিদায় নিচ্ছে না। তার মানে আমাদের হয়তো আরও দীর্ঘদিন করোনার সাথেই বসবাস করতে হবে। আবার অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে সবকিছু ধীরে ধীরে সচলও করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই খুলে দেয়ার মেকানিজমগুলো আমাদের ঠিকঠাক আছে কি না, সেই পদ্ধতি বা নির্দেশনাগুলো আরোপের আগে এ বিষয়ে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ নেয়া হচ্ছে কি না? কারণ করোনা ইস্যুতে এরকম অনেক সিদ্ধান্তই এসেছে যেগুলো সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সাথে সাংঘর্ষিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। অতএব সাংঘর্ষিক ও সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত নিয়ে নীতিনির্ধারকরা কোটি কোটি মানুষকে নতুন করে ঝুঁকিতে ফেলবেন না—এমনটাই প্রত্যাশা।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর