কোভিড-১৯ মহামারিতে যখন পুরো বিশ্ব বিপর্যস্ত তখন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন-ভারতের মধ্যকার সীমান্ত সংঘাত এই অঞ্চলে বাড়তি উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন সময় উত্তেজনা বাড়লেও ১৯৬৭ সালের পর এই প্রথম সীমান্ত নিয়ে সংঘর্ষে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এই সংঘাতের সূত্রপাত মূলত গত এপ্রিলের শেষের দিকে যখন চীন দুই দেশের মধ্যকার বিতর্কিত ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ (এলএসি) বরাবর তার কয়েক হাজার সেনা প্রেরণ করেছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, বিরোধপূর্ণ সীমান্ত বরাবর চীনের এই আগ্রাসী সামরিক পদক্ষেপ ১৯৯৩, ১৯৯৬, এবং ২০১৩ সালের ভিন্ন ভিন্ন তিনটি দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন, যা মূলত এই অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছিল।
উল্লেখ্য যে, এই বিরোধপূর্ণ এলাকায় সংঘাত যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও এর নেতৃত্বে দুই দেশের মধ্যে ‘মেইন্টেন্যান্স অফ পিস এন্ড ট্রাংকুয়েলিটি’ চুক্তি, এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে ‘আস্থা বর্ধক ব্যবস্থাপত্র’ এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে ‘বর্ডার ডিফেন্স কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিগুলোর কল্যাণে বিগত কয়েক দশক ধরে দুই দেশের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ এই সীমান্তে কোনো গোলাগুলি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে ভারত ও চীনের মধ্যকার সীমান্ত দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলে আরো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের অবস্থান সুনিশ্চিত করবে, আর তা হলো জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে জাপানের অর্থনীতি যখন পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছিল তখন দক্ষিণ এশিয়া ভৌগোলিক কারণে জাপানের দৃষ্টির বাইরে রয়ে যায়। ১৯৭০-এর দশকে ‘নিক্সন শক’ পরবর্তী সময়ে চীন-জাপান অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে তৎকালীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকেও ফুকুদার অসাধারণ নেতৃত্বগুণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথেও জাপানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই জাপানের কাছে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এর পেছনে যে বিষয়গুলো অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে তা হলো—এক) চীনের সাথে জাপানের অ-বন্ধুসুলভ সম্পর্ক এবং পূর্ব চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক তৎপরতা, দুই) দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ এবং ঐ অঞ্চলের বাজারে চীনা পণ্যের উচ্চ চাহিদা, তিন) ভারত মহাসাগরের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব, চার) ভারতের উত্থান এবং এই অঞ্চলে ভারতের কার্যত আধিপত্য, এবং পাঁচ) দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল বাজার এবং জাপানি বিনিয়োগের উত্তম পরিবেশ।
বর্তমানে উদ্ভূত করোনাভাইরাস মহামারি এবং চীন-ভারত দ্বন্দ্ব জাপানের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি এই ঝোঁক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনাভাইরাস সময়কালীন বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার বিপর্যয়ের দরুন পুরো বিশ্ব যখন নয়া অর্থনৈতিক মেরুকরণের চিন্তাভাবনা শুরু করেছে তখন জাপানও নতুন করে তাদের পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য এবং চীনা নির্ভরশীলতা হ্রাস করার লক্ষ্যে তাদের বেশকিছু বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান চীন থেকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর বাস্তবিক প্রয়োগ হিসেবে দেখি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ইতোমধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা হিসেবে প্রায় ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। নিরাপত্তা এবং কৌশলগত কারণে সনি, টয়োটা থেকে শুরু করে প্রায় ৮৭টি জাপানিজ কোম্পানি ইতোমধ্যে চীন ছাড়তে রাজিও হয়েছে।
চীন থেকে জাপানি কোম্পানি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হবার পর থেকেই ভারত, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো জাপানি বিনিয়োগ স্ব স্ব দেশে নেওয়ার লক্ষ্যে চেষ্টা তদবির শুরু করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব, মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং এই অঞ্চলের বিশাল বাজারের কারণে দক্ষিণ এশিয়াকে এগিয়ে রাখাই শ্রেয়। বিশেষ করে চীন-ভারত যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ভারতে চীনা পণ্য বয়কটের ঘোষণা জাপানি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগ ভারতে জাপানি কোম্পানির বিনিয়োগ সহসাই বেগবান হবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও বাড়তি সুবিধা পেতে পারে, তবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা কতটুকু জোরদার করতে পারছি, জাপানি বিনিয়োগের জন্য কতটা স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারছি, এবং তাদের কোম্পানিগুলোর কতটা নিরাপত্তা প্রদান করতে পারছি তার ওপর।
এবার আসা যাক ভূ-কৌশলগত কারণে দক্ষিণ এশিয়া কেন জাপানের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ সে বিষয়ে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বিবেচনায় রাখতে হবে ভারত মহাসাগরের ভূ-কৌশলগত অবস্থাকে। জাপান তার শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মেটাতে কাঁচামালের একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করে এবং সমুদ্র-বাণিজ্যের প্রধানতম রুট হিসেবে ভারত মহাসাগর জাপানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু চীন তার ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’-এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগর তীরবর্তী বিভিন্ন দেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে এবং বিভিন্ন দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে, ফলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে কোনো ধরনের গোলযোগ দেখা দিলে জাপানের এই সমুদ্র-বাণিজ্য নিঃসন্দেহে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে। জাপান তার নৌ-রুট নিরবিচ্ছিন্ন রাখার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ‘বে অফ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ (বিগ-বি)-এর মত মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বিআরআই এর বিকল্প স্বরূপ অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ‘কোয়াড’ গঠন করেছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের উত্থান এবং সামরিক দিক থেকে আধুনিকায়ন জাপানকে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার দিকে টানার অন্যতম প্রধান কারণ। পূর্ব চীন সাগর এবং ভারত মহাসাগরে জাপান-ভারতের বা জাপান-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়া সেদিকটিই ইঙ্গিত করে কেননা জাপানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯ জাপানকে তার সীমান্তের বাইরে অন্য কোনো দেশের সাথে যুদ্ধ বা সংঘাতে অংশগ্রহণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। এক্ষেত্রে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত ঘটলে জাপান যেন তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা পায় তা নিশ্চিত করাই জাপানের মূল লক্ষ্য।
পাশাপাশি, জাপান দীর্ঘদিন ধরেই তার পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে আসছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার উপস্থিতি কমিয়ে এনেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়ন, শিনজো আবের সংবিধান সংশোধনের প্রচেষ্টা এবং ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক অস্থিরতা জাপানকে তার অর্থনীতির খোলস থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবার প্রভাব বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এক্ষেত্রে জাপান প্রথমেই চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এই অঞ্চলে তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একধরনের নিরাপত্তা বলয় নিশ্চিত করতে, যেখানে চীনকে প্রধান শত্রু হিসেবেই মূলত উপস্থাপন করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়া জাপানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একইসাথে, জাপান এবং ভারত দীর্ঘদিন ধরেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়ার জন্য তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এক্ষেত্রে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই হয়তো অদূর ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিষদের পরিবর্তন বা সংখ্যাবৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে।
মূলত, সাম্প্রতিক এই চীন-ভারত যুদ্ধে জাপান হয়তো দক্ষিণ এশিয়ায় তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ঘটাতে পারবে না, কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে চলে আসা জাপানের দক্ষিণ এশিয়া ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতিকে যে আরো বেগবান করবে তা সহজেই অনুমেয়। কেননা, ভূ-কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক কারণে দক্ষিন-এশিয়া যেমন জাপানের কাছে খুবই অর্থবহ, তেমনি এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং কাঠামোগত উন্নয়নের জন্য জাপানের বিনিয়োগ অনস্বীকার্য। অন্যদিকে, যেহেতু ভারত এবং জাপান উভয়েরই শত্রু হিসেবে চীনকেই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে, ফলে চীন-ভারত যুদ্ধ ভারত-জাপানকে অর্থনৈতিক, সামরিক, এবং কৌশলগত জায়গা থেকে আরো ঘনিষ্ঠ করে তুলবে এবং একই সাথে কোভিড-১৯ মহামারিকালীন এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের দরুন দক্ষিণ এশিয়ায় জাপানের বিনিয়োগ নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাবে।
ফলে, এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং সাম্প্রতিক চীন-ভারত যুদ্ধ এই অঞ্চলে জাপানকে বা জাপানের প্রভাব বিস্তারকে কিছুটা হলেও সুযোগ করে দেবে, কেননা এখানে উভয়ের স্বার্থই জড়িত।
মো. সাইফুল্লাহ আকন
শিক্ষক, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়