আবাসিকে মিটারবিহীন গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রশ্নে স্রেফ সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
সূত্র বলছে, সরকারের ভয়েই এমন একটি অমূলক আবেদন সরাসরি বাতিল করতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। বরং ঝুলিয়ে রেখেছে বছরাধিক কাল ধরে। অথচ এব্যাপারে দালিলিক নথিপত্র বলছে এখনই এই দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। এতে উভয় সঙ্কটে পড়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না বিইআরসি। এই অহেতুক কালক্ষেপণকে নজিরবিহীন বলছেন জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্টরা। এমনকি বিষয়টিকে বেআইনিও বলছেন তারা। কারণ দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে না পারায় এক বছর ধরে মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের গ্যাস বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর আবেদনটিও ঝুলিয়ে রেখেছে বিইআরসি।
দীর্ঘদিন এভাবে আবেদন ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ নেই। হয় গ্রহণ করবে না হয়, বাতিল করে দেবে। এহেন সিদ্ধান্তহীনতা বিইআরসির জন্য আত্মঘাতি হতে পারে বলেই মত সংশ্লিষ্টদের।
তারা বলছেন, এতে করে বিইআরসি অকার্যকর হয়ে পড়বে। এক সময় ‘মৃত ঘোড়ায়’ পরিণত হবে সংস্থাটি!
যার মোক্ষম সুযোগটি তারাই নেবে যারা বিইআরসিকে অকার্যকর করে রাখতে চায়। এই ঘটনার নজীর টেনে তারা বলার বলার সুযোগ পাবে, বিইআরসির সক্ষমতা নেই। তারা সহজেই বলতে পারবে বিইআরসি সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। যে ঢাল ব্যবহার করে এর আগেও বিইআরসি আইনকে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে।
দেশে বর্তমানে মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের কাছ থেকে নির্ধারিত পরিমাণ গ্যাসের বিল আদায় করা হয়। গ্রাহক ব্যবহার করুক, না করুক অথবা বেশি ব্যবহার করলেও নির্ধারিত বিলই তাকে দিতে হয়।
এ অবস্থায় তিতাস গ্যাস বিদ্যমান এক চুলাবিশিষ্ট সংযোগে ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) বরাদ্দ থেকে বাড়িয়ে ৭৬.৬৫ ঘনমিটার করার এবং দুই চুলাবিশিষ্ট সংযোগে ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) বরাদ্দ থেকে বাড়িয়ে ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার আবেদন দিয়েছে।
গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই দামও বেড়ে যাওয়ার কথা। বিইআরসি সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশ দেয় ২০২২ সালের ৫ জুন। ওই আদেশ দেওয়ার আগে মার্চে গণশুনানি নেয়। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারি গ্রাহকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায় গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার ব্যবহার করছে। প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে এক চুলা ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৭৭.৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়। বিইআরসির সেই আদেশের ১০ মাস পর আপত্তি জানায় তিতাস। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি তার আবেদনে বলেছে, মিটারবিহীন কমবেশি ২৫ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে কোনো সমীক্ষা বা তথ্য বিশ্লেষণ না করেই গ্যাস বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। এতে কারিগরি ক্ষতি বেড়েছে এবং সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠান তিতাস আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
বিইআরসির সাবেক সদস্য (গ্যাস ২০২২) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪কমকে বলেছেন, তিতাস গ্যাসের অভিযোগ সত্য নয়। তার মতে, এই বরাদ্দ ৫০ ঘনমিটারের নিচে করা উচিত ছিল।
মকবুল চৌধুরী বলেন, তিতাসের যে সাড়ে ৩ লাখ প্রিপেইড মিটার ছিল সেখানে দেখা গেছে গড়ে ৪৫ ঘনমিটারের কম ব্যবহৃত হয়েছে। প্রিপেইড মিটারের বিলের তথ্য দেখলেই তা জানা যায়। বিষয়টির জন্য রকেট সায়েন্স জানা দরকার হয় না।
সারাদেশে প্রায় ৪৪ লাখ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে, তার মধ্যে ৫ লাখের মতো প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারিদের তথ্য প্রমাণ কোনভাবেই গ্যাস কোম্পানিগুলোর দাবিকে সমর্থন করে না। বেশিরভাগ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গড়ে ৩০ ঘনমিটারের কম গ্যাস ব্যবহার করছেন প্রিপেইড গ্রাহকরা। হাতের নাগালে সেসব তথ্য জ্বলজ্বল করছে। শুধু সেই পরিসংখ্যান নয় ২০১৯ সালে বিআইডিএসকে (বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান) দিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে বিইআরসি। মূল লক্ষ্য ছিল আবাসিকে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারি ও মিটার বিহীন গ্রাহকদের গ্যাস ব্যবহারের একটি চিত্র তুলে আনা।
এতে দেশের ৬টি কোম্পানির গ্রাহকের উপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। সেই রিপোর্টও হাতে রয়েছে বিইআরসির।
যদিও রিপোর্টটি রহস্যজনক কারণে চাপা দিয়ে রেখেছে সংস্থাটি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর ওই প্রতিবেদনটি দাখিল করেন বিআইডিএস এর সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ ও তার টিম। ওই রিপোর্টে ছোট পরিবার, বড় পরিবার, বিতরণ কোম্পানি ভেদে ব্যবহারের তারতম্য এমনকি মিটার ও ননমিটারের মধ্যেও পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে।
১৩ জেলার ১০৫৪ আবাসিক গ্রাহকের উপর পরিচালিত সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে, একক চুলার প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকরা ৩৫.৫ ঘনমিটার ও দুই চলার গ্রাহকরা ৫৯.৩ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করছে। গড়ে ৫৭.৯ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেছেন মিটার ব্যবহারকারিরা। আর ননমিটার গ্রাহকরা গড়ে ৫৬ মিটার গ্যাস ব্যবহার করেছেন। এতো এতো সব তথ্য থাকার পরও ৩৯ লাখ মিটারবিহীন গ্রাহকদের পকেট কাটার উদ্যোগ নিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। আর সবকিছু জানার পরও আবেদনটি বাতিল করার সাহস দেখাতে পারছে না বিইআরসি।
অতীতে অসম্পুর্ণ এবং অন্যায্য প্রস্তাব কমিশনের বৈঠকেই বাতিল করার অনেক নজীর রয়েছে। কিন্তু এখন ধরে রেখে অযথাই বিতর্কের পথে হাটছে কমিশন। আগে কখনও ১ বছর ধরে কোন দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব ঝুলে রাখার নজীর নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তিতাস গ্যাসের ওই আবেদন বিলম্বিত হওয়া প্রসঙ্গে বিইআরসির চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, তাদের আবেদনে কিছু কাগজপত্র ঘাটতি থাকায় জমা দিতে বলা হয়। তারা দিতে বিলম্ব করেছে যে কারণে সময় লেগেছে। এরপর পরিচালক গ্যাসকে সদস্য করে একটি কমিটি করে দেওয়া হয় যারা যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট দেন। ওই রিপোর্ট নিয়ে কাজ চলছে।
এক বছর ধরে ঝুলে রাখায় আইনগত দিক জানতে চাওয়া হলে তিনি কোন ব্যতিত হয়নি বলে দাবি করেন।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, সরকারের ভয়েই সিদ্ধান্তহীনতায় বিইআরসি। কমিশনের ভয়ের একটি বড় কারণ হচ্ছে মাত্র যখন পাখনা গজাচ্ছিল তখনই বিইআরসির ডানা কেটে খাঁচায় বন্দি করে সরকার। ২০২৩ সালে আইন সংশোধন করে নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে কার্যত বেকার হয়ে পড়েছে আধাবিচারিক প্রতিষ্ঠানটি। কেউ কেউ কমিশনকে এখন মৃত ঘোড়া বলতেও ছাড়ছেন না।
২০০৩ সালে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন পাশের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ও আধাবিচারিক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠিত হয় বিইআরসি। গ্যাস ও বিদ্যুতের বিতরণ কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা এবং ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত এই কমিশন মূলত ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। এ পর্যন্ত ১১টি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করেছে। আর ১২টি প্রবিধানমালা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আইনে সকল ধরণের জ্বালানির দাম নির্ধারণের এখতিয়ার দেওয়া প্রবিধানমালা ঝুলে থাকায় শুধুমাত্র গ্যাসের গ্রাহক পর্যায়ে এবং বিদ্যুতের পাইকারি ও গ্রাহক পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে আসছিল বিইআরসি। জ্বালানি তেলের দাম বরাবরেই নির্বাহী আদেশে দিয়ে আসছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। যার দায়িত্ব কখনোই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির হাতে আসেনি।