শিল্পের সঙ্গে আবাসিকেও গ্যাসের দাম বাড়াতে চায় তিতাস
মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের বিলও বাড়াতে চায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের সঙ্গে এই বিষয়টি থাকছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ।
তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকরা অনেক বেশি গ্যাস ব্যবহার করছে। একক চুলা ৫৫ ঘনমিটারের বিল ও দুই চুলা ৬০ ঘনমিটারের বিল আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে ১০০ ঘনমিটার পর্যন্ত গ্যাস ব্যবহারের রেকর্ড রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারি ও ননমিটার গ্রাহকের ব্যবহারের মধ্যে অনেক তারতম্য রয়েছে। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারি গ্রাহক অনেকটা মিতব্যায়ী হন। তাই তাদের ব্যবহারের পরিমাণ অনেক কম হয়ে থাকে। প্রিপেইড মিটার রয়েছে অভিজাত এলাকায় তারা অনেক সময় হোটেল-রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে তুলনা করলে চলে না।
গত ৬ জানুয়ারি বিদ্যমান গ্রাহকদের দর অপরিবর্তিত রেখে নতুন শিল্প কারখানার বয়লার ও শিল্প কারখানার জেনারেটরে (ক্যাপটিভ) সরবরাহ গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা। আইনগতভাবে পেট্রোবাংলার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই। কেবলমাত্র লাইসেন্সী দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারেন। সে কারণে বিতরণে কোম্পানিগুলোর কাছে মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব চেয়েছে বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন)। ৭ জানুয়ারি ইস্যু করা পত্রে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে ট্যারিফ পরিবর্তনের প্রস্তাব কমিশনে দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।
মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকের নির্ধারিত পরিমাণ গ্যাসের বিল আদায় করা হয়। গ্রাহক ব্যবহার করুক, না করুক অথবা বেশি ব্যবহার করলেও নির্ধারিত বিলেই তাকে দিতে হয়। বিইআরসি সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশ দেয় ২০২২ সালের ৫ জুন। ওই আদেশের পুর্বে গণশুনানি গ্রহণ করে। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারি গ্রাহকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায় গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার ব্যবহার করছে। প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে এক চুলা ৭৩.৪১ ঘনমিটার ও দুই চুলা ৭৭.৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়।
বিইআরসির আদেশের ১০ মাস পর তিতাস গ্যাস বিদ্যমান এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার (৯৯০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৭৬.৬৫ ঘনমিটার দুই চুলা ৬০ ঘনমিটার (১০৮০ টাকা) থেকে বাড়িয়ে ৮৮.৪৪ ঘনমিটার করার আবেদন দিয়েছে। আর পরিমাণ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই দামও বেড়ে যাবে। তিতাস তার আবেদনে বলেছে, মিটার বিহীন কমবেশি ২৫ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে কোনো সমীক্ষা বা তথ্য বিশ্লেষণ না করেই ঘনমিটারের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। এতে কারিগরি ক্ষতি বেড়েছে এবং সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠান তিতাস আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
বিইআরসির তৎকালীন সদস্য (গ্যাস ২০২২) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪কমকে বলেছেন, তিতাস গ্যাসের অভিযোগ সত্য নয়। আমারতো মনে হয় ৫০ ঘনমিটারের নিচে করা উচিত ছিল। তাদের যে সাড়ে ৩ লাখ প্রিপেইড মিটার ছিল সেখানে দেখা গেছে গড়ে ৪৫ ঘনমিটারের কম ব্যবহৃত হয়েছে। প্রিপেইড মিটারের বিলের তথ্য দেখলেই বুঝতে পারা যায়। বিষয়টির জন্য রকেট সায়েন্স জানা দরকার হয় না।
তিতাসের ওই আবেদনটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁলিয়ে রেখেছে বিইআরসি। কমিশন একটি কমিটি গঠন করেছিল, সেই কমিটির রিপোর্টও আলোর মুখ দেখেনি। বিইআরসি গণশুনানিতে মিটার বিহীন আবাসিক গ্রাহকের ওই প্রস্তাবটিও তোলার পক্ষে ইতিবাচক চিন্তা করছে বলে সুত্র নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে বিব্রতবোধ করছেন বিতরণ কোম্পানিগুলো। তারা কেউই শিল্প ও ক্যাপটিভে ১৫২ শতাংশ দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা দেখছেন না। একাধিক কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, পেট্রোবাংলা আমাদের কাঁধে বন্দুক রেখে দাম বাড়াতে চাইছে। গণশুনানিতে ভোক্তাদের মুখোমুখি হতে হবে আমাদেক। অথচ আমরা এই দাম বাড়ানোর সঙ্গে মোটেই একমত নই। আমরা যতটুকু জেনেছি মন্ত্রণালয়ের চাওয়ার অনুযায়ী নতুন দর ফর্মুলা প্রস্তুত করা হয়েছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে হচ্ছে।
কোম্পানিগুলো কেউ কেউ এটাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। সুন্দরবন কোম্পানিসহ অনেকেই বিতরণ চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের বিদ্যমান হুইলিং চার্জ রয়েছে ২৪ পয়সা, এতে আমাদের লোকসান হচ্ছে। আমরা ৩২ অথবা ৩৪ পয়সা বিতরণ চার্জ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করতে পারি।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড থেকে ১ টাকা দরে, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি থেকে ১.২৫ টাকা দরে, বাপেক্স থেকে ৪ টাকা দরে প্রতি ঘনফুট গ্যাস কেনা হয়। এরপর বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ও টাল্লোর কাছ থেকে কেনা গ্যাসের সংমিশ্রণে গড় দর দাঁড়ায় ৬.০৭ টাকা ঘনমিটার।
পেট্রোবাংলার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলেছে, প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫.৭০ টাকা। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৫.৭২ টাকা। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের প্রাইস গ্যাপ কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার ঘাটতি হবে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তারা অবিলম্বে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া বন্ধ করার দাবী জানিয়েছেন। ওই প্রস্তাব অনুমোদন হলে শিল্পায়ন বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা।
পেট্রোবাংলা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করার জন্য টেকনিক্যাল গঠন করেছে বিইআরসি। নিয়ম অনুযায়ি টেকনিক্যাল কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর গণশুনানি নিয়ে আদেশ দেওয়া হয়।