সুদ বৈষম্য : কম সুদে ব্যাংকের টাকা নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ

, অর্থনীতি

জুনায়েদ শিশির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 03:53:11

ঢাকা: ব্যবসায় বিনিয়োগের নামে ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নিয়ে সেই টাকার সঞ্চয়পত্র কিনছেন অনেক উদ্যোক্তা। একই অবস্থা তৈরি হচ্ছে, শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রেও। বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে সঞ্চয়পত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে সুদের হার এক অংকে নিয়ে আসা এবং শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতায় এ সুযোগ গ্রহণ করছে বলে জানা যায়। এতে একদিকে যেমন ব্যাংক ঋণের অর্থের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদ বেশি হওয়ায় সরকারের বাজেট ব্যয় বাড়ছে। যা বাজেট ঘাটতি বাড়ানোর পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকার ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদ হার কমিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে তা কার্যকরও হয়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার সমন্বয় করা এখন খুবই জরুরি বলে মনে ব্যবসায়ী নেতা ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। কেননা ব্যাংকে বর্তমানে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ। আর সঞ্চয়পত্রের সুদ হার সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ।

এজন্য দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের স্বার্থে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমানো উচিত বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও বিদায়ি অর্থবছরে (২০১৭-১৮) এর সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েও বাস্তাবায়ন করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বরং চলতি অর্থবছরেও (২০১৮-১৯) একই হারেই চলছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি।  

সুদ হারের বৈষম্যের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় সরকারকে বেশি সুদ গুণতে হচ্ছে। এটা কমিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। যেহেতু ব্যাংক সুদের হার কমেছে সঞ্চয়পত্রের সুদও কমবে বলে আমরা আশা করি।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের সুদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত, এসেছে। এখন অন্য কোন বৈষম্য থাকলে তার বিষয়েও এফবিসিসিআই কথা বলবে। সঞ্চয় পত্রের মাধ্যমে সরকার টাকা তুলবে এটা ঠিক আছে। কিন্তু এর সুদের হারের বিষয়ও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। দেশের আর্থিক খাত পুঁজিবাজারকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। উচ্চ সুদের প্রভাব যাতে শেয়ারবাজারে না পড়ে। 

এ বিষয়ে শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ২০০৮ সাল থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদের হারে অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে বা আনা হয়েছে। অপরিকল্পিত এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে তার প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়বেই। বলা হচ্ছে ব্যাংকের সুদের হার কমেছে, কিন্তু এটি মুখেই বলা হচ্ছে। কাজে এখনো বাস্তাবায়ন হয়নি। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। একইভাবে লিজিং কোম্পানিগুলো তাদের সুদের হার কমায়নি। এর ফলে পুঁজিবাজার অস্থিরতা থেকেই যাচ্ছে। বাজার ও বিনিয়োগের স্বার্থে এর একটি স্থায়ী সমাধান জরুরি।

ব্যবসায়ীদের আরেক সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদ হার অনেক বেশি। ব্যাংকারদের সঙ্গে যতবার কথা বলেছি তারা বলছেন ব্যাংক সুদ হার নিয়ন্ত্রণে আনতে বড় বাধা সঞ্চয়পত্রের সুদ। কারণ টাকা ডাইভার্ট হয়ে যায়। ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে সাড়ে ১১ শতাংশে সঞ্চয়পত্র কেনে। এছাড়া এফডিআর সুদ হার যদি ৬ শতাংশ হয় কেউ ব্যাংকে টাকা রাখতে আসবে না। সরকারের একটি বড় দায় হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। সুদ পরিশোধের বড় অংশ চলে যায় সঞ্চয়পত্রে। দীর্ঘ দিন থেকে কথা হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমানো হয় কিন্তু আমরা কোন প্রতিফলন দেখছি না।

তিনি আরও বলেন, স্প্রেড হার ১ থেকে ২ শতাংশ হলে সেটা সহনশীল। কিন্তু ৫ শতাংশের বেশি হলে তার চাপ ব্যাংক ঋণের ওপর পড়বে। আমরা চাই সব ধরণের সুদ হার একটি সামঞ্জস্য পর্যায়ে নিয়ে আসা হোক।

জানা গেছে, অনেকেই ব্যাংক থেকে সিঙ্গেল ডিজেটে ঋণ নিয়ে তার একটা বড় অংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন অধিক মুনাফার লোভে। কেননা ব্যাংকে বর্তমানে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ। আর সঞ্চয়পত্রের সুদ হার সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। ব্যাংকের সুদের চেয়ে আড়াই শতাংশ বেশি। এছাড়া ব্যাংক আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরফলে ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ। অধিক মুনাফার আশায় তারা সঞ্চয়পত্রেই বিনিয়োগ করবেন। আবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে গিয়ে বেশি পরিমাণে সুদ গুণতে হবে। এতে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমিয়ে দিয়ে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেবে। আবার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে সঞ্চয়ত্রের সুদের হার সমন্বয় করা এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

বর্তমানে দেশে বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র প্রকল্পের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে পাওয়া যায় ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ সুদ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এখন ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ কার্যকর রয়েছে। এটা গত অর্থবছরের মতই নতুন বাজেটেও বহাল রাখা হয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী নিজেই একাধিকবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সমন্বয়ের কথা বলেছিলেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর