প্রাকৃতিক বিরূপতায় শিক্ষা কার্যক্রম গতিশীল রাখা জরুরি

, শিক্ষা

কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-05-07 21:27:44

 

শিক্ষা কার্যক্রম একটি সার্বক্ষণিক বিষয়। মাইনাস ডিগ্রির শীতের মেরুদেশে কিংবা উষ্ণতম মরুদেশেও সর্বক্ষণ শিক্ষা কার্যক্রম চলমান। বাংলাদেশে বিরূপ প্রকৃতি দেখা দিলেই থমকে দাঁড়ায় শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ। বন্ধ করে দেওয়া হয় স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও। কিন্তু প্রাকৃতিক বিরূপতার মধ্যেও শিক্ষা কার্যক্রম গতিশীলভাবে পরিচালনা করা অতীব জরুরি। আর এজন্য দরকার সঠিক পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় চলতি গরমের পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়েছিল নানা দোলাচল এবং এক পর্যায়ে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জরুরি নোটিশে কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। তীব্র শৈত্যপ্রবাহের সময়েও শিক্ষা কার্যক্রম বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। প্রচণ্ড বর্ষাতেও ব্যাহত হয় প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা। বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আবহাওয়া বৈরী হয়ে ভীষণ গরম ও তীব্র শীত কিংবা অতি বা অনাবৃষ্টির মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশসহ নানা দেশে। বিরূপ পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়াই একমাত্র সমাধান নয়। বরং শিক্ষাক্ষেত্রকে বৈরী প্রকৃতিতে কার্যকর থাকার প্রস্তুতি নেওয়া ও সক্ষমতা অর্জন করাই জরুরি।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাকৃতিক বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ ও দক্ষতা অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা সাম্প্রতিক বাস্তবতার পটভূমিতে অস্বীকার করা যায় না। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রাণ, প্রকৃত ও পরিবেশ বিরোধী কার্যকলাপের দরুণ বাংলাদেশের আবহাওয়া যেভাবে ক্রমেই চরম ভাবাপন্ন হচ্ছে, তাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের করণীয় নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরি। যার ভিত্তিতে বিরূপ পরিস্থিতিতেও শিক্ষা কাযর্ক্রম অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। পরিস্থিতি খারাপ হলেই বন্ধ ঘোষণার পথে না গিয়ে টেকসই হওয়ার দিকেই সংশ্লিষ্টদের মনোযোগী হওয়া অত্যাবশ্যক।

সর্বাগ্রে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, আমরা যদি রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সতর্ক ও উদ্দ্যোগী না হই, তাহলে বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে গরম ও শীত দিনে দিনে তীব্র থেকে তীব্রতর এবং দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবেই। প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করলে কঠিন ফল ভোগ করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। এরই মাঝে নানা রকমের বিপদ এসে হাজিরও হয়েছে এবং ভবিষ্যতের দিনগুলোতে আরো বিপদ আসার আশঙ্কাও রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, বায়ুমানের অবনতি, পরিবেশ বিপর্যয়, জলস্তর হ্রাস, মরু প্রবণতা, জমির উর্বরা শক্তিহানি, প্রাণ ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের অবলুপ্তি ইত্যাদি। যে কারণে, অতিরিক্ত গরম বা অতিরিক্ত ঠাণ্ডার মতো চরমভাবাপন্ন পরিস্থিতিও একদার নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে।

ফলে প্রচণ্ড শীত বা বাড়তি গরম হলেই ছুটি দেওয়া একমাত্র সমাধান হতে পারে না। বাস্তব সমাধানের কথা ভাবাই বরং অতি জরুরি। এজন্য কিছু পরিবর্তন, অদল-বদল বা সংস্কার দরকার। যেমন:

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত পরিকাঠামোর উন্নয়ন দরকার সবচেয়ে আগে। যে সব স্কুলের ক্লাসরুমে টিনের ছাউনি আছে, সে সব স্কুলে স্থায়ী ছাদের ব্যবস্থা করতে হবে। ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে তাপ-সহনীয় মান বজায় রেখে। প্রতি ক্লাসরুমে ছাত্র অনুপাতে পর্যাপ্ত ফ্যান এবং প্রাকৃতিকভাবে হাওয়া-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। সম্ভব হলে, স্কুলকে ছায়াদায়ী বৃক্ষের আচ্ছাদনে এবং প্রচুর উদ্ভিদের আড়ালে সবুজ, সজিব ও শীতল রাখতে হবে। বৃক্ষ ও প্রকৃতি শুধু গ্রীষ্মের তীব্র গরমই নয়, শীতের ঠাণ্ডা হাওয়াও ঠেকাতে সাহায্য করবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরমে পাখা এবং শীতে হিটারের ব্যবস্থার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক পাওয়ার সাপোর্টের জন্য বা লো ভোল্টেজ আর লোডশেডিং-এর সমস্যা এড়াতে ব্যাটারি, সোলার প্যানেল বা জেনারেটরের ব্যবস্থা করে দেওয়াও দরকার।

ক্লাসরুমে ভেজা পর্দা, কুঁজো বা মাটির কলসির পানি ব্যবহার, স্যালাইন বা প্রাকৃতিকভাবে শীতল পানির জোগান প্রভৃতি ব্যবস্থা করা যায়। গরমজনিত অসুস্থতা রুখতে প্রশিক্ষণ ও প্রাথমিক কিছু ওষুধের জোগান দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে শরবত বা লেবুর পানি বহনের জন্য প্রণোদিত করতে হবে এবং সব ধরনের প্যাকেটজাত কোমল পাণীয় পান এবং জাঙ্ক ফুট গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের গরম বা আবহাওয়াজনীত অসুখের কবল থেকে নিরাপদ রাখার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের একযোগে কাজ করতে হবে।

স্কুল টাইমিং-এর দিকেও মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছণীয়। ‘মর্নিং স্কুল’ ভাল বিকল্প। বর্তমানে অনেক জায়গায় প্রাথমিকে অনেক সকালের দিকে স্কুল হয়। এতে তাপ ও ভিড় থেকে শিক্ষার্থীরা রেহাই পায়।

স্কুলে লম্বা গরমের বা অন্যান্য ছুটিতে অনলাইনে ক্লাস করার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা যায়। বাড়িতে পড়ানোর জন্য অনলাইনে নজরদারিও বৃদ্ধি করা যায়। শুধু স্কুলেই সব পড়তে হবে, এমন না করে শিক্ষার্থীদের বাড়িতেও স্কুল ও শিক্ষকদের অনলাইন মনিটরিং-এর আওতায় আনলে তাদের পাঠের গতি বৃদ্ধি পাবে এবং সিলেবাস শেষ না হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হাতে কেবলমাত্র ‘কাস্টমাইজ়ড ট্যাব বা মোবাইল’ (শুধুমাত্র পড়াশোনার কাজে ব্যবহারযোগ্য) দেওয়া যেতে পারে, যার সঙ্গে থাকবে সুলভ ডাটা প্যাক। এতে তীব্র গরমের বা অনসহনীয় শীতে ছুটি দেওয়ার মাত্রা কমবে এবং ছুটি হলেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা নির্বিঘ্নে চলতে পারবে।

প্রাকৃতিক বিরূপতায় বন্ধ দিয়ে বা স্থবির হয়ে নয়, কিছু কাঠামো ও নিয়ম-কানুন বদল করে শিক্ষা কার্যক্রম গতিশীল রাখাই জরুরি কর্তব্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর