রাজধানীর অন্যতম বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা সিটি কলেজের ক্লাস-পরীক্ষা ১৬ দিন ধরে বন্ধ। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, নিজের চেয়ার বাঁচাতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজী মোহাম্মদ নিয়ামুল হক কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণায় অনিশ্চিয়তায় পড়েছেন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের অন্তত ১১ হাজার শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৭ আগস্ট নিয়ম বহির্ভুতভাবে নিজেই নিয়মিত অধ্যক্ষকে সরিয়ে চেয়ারে বসেন অধ্যাপক কাজী নিয়ামুল। দায়িত্ব নিয়েই একাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শোকজ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করেন। চাকরিচ্যুতসহ নানা স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে গত ২৮ অক্টোবর আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষসহ ৪ শিক্ষকের পত্যাগের পাশাপাশি সাতদফা দাবি জানানো হয়। তবে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। তাই বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের রোষ থেকে বাঁচতে মৌখিকভাবে ২৯ অক্টোবর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়।
পরে গত ৪ নভেম্বর সংক্ষিপ্ত এক নোটিশে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় সিটি কলেজ। এতে অনিশ্চিয়তায় পড়েছেন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের অন্তত ১১ হাজার শিক্ষার্থী।
দুই লাইনের ওই নোটিশে কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়াই বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। যদিও ওই নোটিশে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজী নিয়ামুলের কোনো স্বাক্ষর ছিলো না।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কলেজের একজন অধ্যক্ষ তার ক্ষমতা বলে বছরে সর্বোচ্চ তিনদিন বন্ধ রাখতে পারেন। সে হিসেবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা স্পষ্ট।
কলেজ বন্ধ রাখার বিষয়ে জানতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কাজী নিয়ামুলের হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বহিরাগতদের দিয়ে সিটি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর বেদার উদ্দিন আহমেদকে জিম্মি করে পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়। পরে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেন একই কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর কাজী নিয়ামুল হক। আর উপাধ্যক্ষ্যের চেয়ারে বসেন মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর মো. মোখলেছুর রহমান। এই ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ দেওয়ার পাশাপাশি উচ্চ আদালতে রিট করেন বেদার উদ্দিন।
গত ২৭ অক্টোবর উচ্চ আদালতের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে আদালত জানতে চেয়েছেন, কেনো কাজী নিয়ামুল ও মোখলেছুর রহমানের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালককে তদন্ত করে চার সপ্তাহের মধ্যে আবেদনকারী সাবেক অধ্যক্ষ বেদার উদ্দিন আহমেদের আবেদন নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন।
জানা গেছে, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আমানুল্লা ফেরদৌস দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন। কমিটির প্রধান করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মেজবাহ উল ইসলামকে। আর সদস্য করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমানকে। তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে রিটকারীসহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য শুনেছেন।
নিয়মিত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য করানো ছাড়াও দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৬ জনকে চাকরিচ্যুত করেন কাজী নিয়ামুল। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে চারজনকে চাকরি ফিরিয়ে দিলেও এখনো ১২ জন আছেন অনিশ্চয়তার মধ্যে।চাকরিচ্যুতদের মধ্যে আছেন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষসহ ৮ জন শিক্ষক এবং গাড়িচালক ও পিয়নসহ ৪ জন কর্মচারী। তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই সব শিক্ষক ও কর্মচারীরা।
এদিকে চাকরি হারানো শিক্ষকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটিও তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তিন মাসে তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। এই সময়ে মাত্র একজন শিক্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। ফলে অনিশ্চয়তায় কাটছে তাদের দিন।
কলেজ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ঢাকা সিটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত হাজার এবং অনার্স-মাস্টার্সে চার হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন এই সব শিক্ষার্থীরা। সময় মতো সিলেবাস শেষ করা নিয়েও তারা শঙ্কায় আছেন। যদিও গত কয়েক দিন ধরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কলেজ খোলার বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করে আসছিলেন। কিন্তু কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে এখনো অনড় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়ামুল।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি কলেজের পরিচালনা কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ফলে সিটি কলেজের কমিটিও ভেঙে দিতে হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ বি এম ওবায়দুল ইসলামকে কমিটির সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের একটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়।
দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে কলেজ বন্ধ থাকার বিষয়ে কমিটির সভাপতি ওবায়দুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, কলেজ বন্ধের ঘোষণা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ একা নেননি। এডহক কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি কলেজ বন্ধ রেখেছেন। কারণ ওই সময় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিলো, উপাধ্যক্ষের পদত্যাগ এবং নিয়মিত অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষকে নিয়োগ দেওয়া। এটা না হলে তারা ক্লাস ফিরবে না। তারা মানতেই চাচ্ছে না নিয়োগ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ইতোমধ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আন্দোলনের নামে ভাঙচুর করবে। শিক্ষকদের অপমান করবে। এই অবস্থায় নিরাপত্তার একটি বিষয় আছে। তাই আমরা দ্রুত কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগের সিদ্ধান্ত দিয়েছি। পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষকে পদত্যাগ করিয়ে নিয়মিত নিয়োগের কাজ চলছে। নিয়োগ করতে সময় লাগবে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে সরিয়ে আমরা কাকে দেবো। যাকে অধ্যক্ষ করবো তাকেও তো শিক্ষার্থীরা নাও মানতে পারে। তাকে পছন্দ নাও হতে পারে। ওদের (শিক্ষার্থীদের) পছন্দ মতো যদি সব হয়ে যায় তাহলে প্রশাসন বলতে কিছু থাকবে না। ক্লাসও ভালো ভাবে হবে না। আমাদের কলেজ চালু করতে হবে।
নিয়মিত অধ্যক্ষের রিটের বিষয়ে তিনি বলেন, ওটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত করছে। যেহেতু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব তদন্ত করার। তারাই দেখুক তদন্ত করে। পরবর্তীতে তারা যদি কোনো নির্দেশনা দেয় তখন আমরা দেখবো।