জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) চলমান ইদ ও গ্রীষ্মের ছুটিতে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকল্প জায়গা থাকা সত্ত্ব্বেও গাছ কেটে 'মেইন বার্ডস লেক' এর কোল ঘেষে দুইটি ভবনের নির্মানকাজ শুরু করেছে প্রশাসন।
লেকটি পরিযায়ী পাখির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। নতুন রেজিস্ট্রার ভবনের পেছনের স্থানে কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন ও বাস্কেটবল গ্রাউন্ড সংলগ্ন চারুকলা অনুষদের ভবন নির্মানের জন্য সকাল থেকে অপরিকল্পিতভাবে প্রায় দুই শতাধিক গাছ কাটার বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। আরও চার শতাধিক ছোট-বড় গাছ কাটা পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রবিবার (২ জুন) সকাল সাড়ে ৮টা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আল-বেরুনী হলের এক্সটেনশন অংশে চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে গাছগুলো কর্তন করা হয়।
মাস্টারপ্ল্যান প্রনয়ণ ব্যতিতই গাছ-পালা কেটে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে ভবন নির্মানকাজ শুরুর ঘটনায় রবিবার বেলা ১১টায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা।
মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতার উল্লেখ করে তাদের ব্যর্থতার বর্ণনা ও মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন ছাড়াই গাছ কাটার প্রতিবাদ জানান আন্দোলনকারীরা।
এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্প্রসারিত ভবন (এক্সটেনশন) নির্মাণের জন্য নতুন প্রশাসনিক ভবনের পেছনের দিকের জায়গায় 'মেইন বার্ডস লেক' এর কোল ঘেষে থাকা গাছগুলো একটি ভেকু মেশিন (এক্সক্যাভেটর) দিয়ে গোড়াসহ মাটি থেকে উপড়ে ফেলা হচ্ছে।
অন্যদিকে, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড সংলগ্ন স্থানে চারুকলা বিভাগের অনুষদ ভবন নির্মাণের জন্যেও প্রকল্প পরিচালক, বিভাগীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে ভেকু মেশিন (এক্সক্যাভেটর) ব্যবহার করে ওই স্থানের সকল গাছ উপড়ে ফেলতে দেখা গেছে।
চারুকলা অনুষদের জন্য নির্ধারিত এই স্থানটিও 'মেইন বার্ডস লেক' এর কোল ঘেঁষা। গাছ কাটার সঙ্গে সঙ্গে ওখানে আশ্রয় নেওয়া দেশি পাখিদের ছোটাছুটিও চোখে পড়ছে। আরও চার শতাধিক ছোট-বড় গাছ কাটা পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৬ মে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় জলাশয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় লেকটিকে 'মেইন বার্ডস লেক' নামেই শনাক্ত করা হয়। এই সভাতে প্রায় ৭.১৫ একর আয়তনের লেকটিকে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জলাশয় ব্যবস্থাপনা কমিটির এ সিদ্ধান্ত গত ২৩ মে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত হয়েছে বলে জানা গেছে৷
তবে ওই স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে নির্মাণকালীন সময় উৎপন্ন শব্দ ও বিশৃঙ্খলায় লেকটি আর পরিযায়ী পাখির জন্য বাসযোগ্য থাকবে না বলে মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী অরিত্র সাত্তার বলেন, জাহাঙ্গীরনগরের প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের পথে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতের বিপরীতে চলছে প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীর নিরসন। বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ বন্য প্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট করে তৈরি হচ্ছে অপরিকল্পিত ভবন। নির্মাণ পরিকল্পনায় দূরদর্শিতার অভাব থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাসের সবুজ প্রকৃতি।
ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের (একাংশের) সাধারণ সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলি বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে তারপর ভবনের কাজে হাত দিতে। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু রদবদল আনলেও আমাদের মূল দাবিকে সব সময়ই উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রশাসন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার ফলে আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিটি অনুষদের ডিনদের প্রতি দাবি জানিয়েছিলাম অংশীজনদের মতামত নিয়ে একাডেমিক বিল্ডিংয়ের কাজে হাত দিতে। আমরা বারবার সংশ্লিষ্ট ডিনদের অনুরোধ করা সত্ত্বেও ছুটির ভেতর গাছে হাত দেওয়া হয়েছে।’
ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের (অপর অংশের) সভাপতি আলিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা দেখেছি কোনো বড় ছুটি শুরু হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ কাটার একটা মহাযজ্ঞ চলে। এবারেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শিক্ষার্থীরা হলে নেই এই সুযোগে গাছ কাটার উৎসবে মেতেছেন তারা। ভবন নির্মাণে আমাদের আপত্তি নেই, আপত্তি সঠিক মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া ভবন নির্মাণে।’
তিনি আরও বলেন, প্রশাসন সব সময় প্রকৃতি বিনাশী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর যুক্তির কাছে হেরে গেছে প্রশাসন। বন্ধের সময় এলেই প্রশাসন গাছ কাঁটতে উদ্যোমী হয়ে ওঠে। চারুকলা ভবন নির্মাণে আজ তারা নিজেদের বিভাগের শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনসহ বিভাগের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে গাছ কাটার সময়। প্রকৃতি ধ্বংসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই অবস্থান জাবিতে নতুন একটি ইতিহাসের জন্ম দিল।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক খো. লুৎফুল এলাহী বলেন, ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির সুযোগে এই ছুটির মাঝে ভবন নির্মাণ করা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। তারা বারবার এ কাজ করছে। কলা ও মানবিকী অনুষদের কাছে আমাদের চাওয়া ছিল ভবনটি যাতে বর্তমান ভবন সংলগ্ন স্থানে করা হয়। এতে ভবন কিছুটা ছোট হলেও পরিবেশ ও প্রাণ প্রকৃতিতে ক্ষতি তেমন ক্ষতি হতো না। কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত না করে তারা লেকের পাশে যে স্থান নির্ধারণ করেছে তাতে অনেক গাছ কাটা পড়বে বলে আমরা আশংকা করেছি। এবং সেই আশংকা সত্যিও হয়েছে। পরিকল্পনা ছাড়া এ ধরনের ভবন নির্মাণ পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরুপ। এই ভবনটি নির্মানের মাধ্যমে তারা তাদের তৃতীয় প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের পথকে সুগম করল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে শিক্ষার্থীরা বাসায় চলে গেছে, আর সেই সুযোগে গাছ কাটা শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, বিপন্ন করে, এমন কোনো কাজ কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। শিক্ষা ও গবেষণার জন্য অবশ্যই ভবনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেটা প্রাণ-প্রকৃতিকে, সৌন্দর্যকে ধ্বংস করে নয়। ৬৯৭ একরের এই বিশ্ববিদ্যালয় ছোট নয়, বিকল্প জায়গাতেও ভবন করা যেত। ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গায় এত গাছপালা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি লেকে মূলত বেশি পাখি আসে। একটি হলো চৌরঙ্গীতে এবং অন্যটি পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থিত লেকটিতে। এখন আর অতিথি পরিযায়ী পাখিরা আসবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। গতকাল (শনিবার) প্রকাশিত সংবাদে দেখলাম, এই উন্নয়ন প্রকল্পের এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) হয়নি। সেটা সত্যি হলে তা হবে খুবই পরিতাপের বিষয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নিশ্চয়ই মিত্র রাষ্ট্র ভারত তাদের আর্থিক সহায়তায় নির্মিতব্য চারুকলা অনুষদের ভবনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যকে বিপন্ন করে এমন কোনো জায়গায় নির্মাণ করতে পরামর্শ দেয়নি! যে ক্ষতি হচ্ছে আর তা নিয়ে বিতর্ক চলছে, তার জন্য দায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ও চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম এম ময়েজ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের নির্ধারিত জায়গাতেই ভবন নির্মাণ করছি। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছুই আমরা করছি না। এ ছাড়া যে গাছগুলো কাটা হয়েছে সেই গাছগুলো আমরা নিজেরাই রোপণ করে পরিচর্যা করব। সকল অংশীজনের সুপারিশকে গ্রহণ করে এবং তাদের নিয়ে আমরা একটা টিম তৈরি করব যাতে তারা আমাদের অগ্রগতিতে লক্ষ রাখতে পারেন।’
অতিরিক্ত অংশের গাছ কাটা নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রো-ভিসি স্যার কি বলেছেন সে সম্পর্কে আমি জানি না। তবে সিন্ডিকেট নির্ধারিত স্থানেই ভবন নির্মাণ হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী গাছ কাটা হচ্ছে। এই অংশে মূলত কন্সট্রাকশন সামগ্রী ও শ্রমিকদের থাকার স্থান তৈরি করা হবে। গাছ কাটার সময় রাজনৈতিক দলের শিক্ষার্থীদের অবস্থান করার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগকে অনুষদে রূপান্তরিত করতে চান বিভাগীয় শিক্ষকরা। এ লক্ষ্যে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে অনুষদ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যার জন্য আল বেরুনী হলের বর্ধিতাংশের স্থানটি নির্ধারণ করা হয়েছে।
ভবন নির্মাণের জন্য ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যার ৪৭ কোটি ৮৯ লাখ ১৭ হাজার টাকা বাংলাদেশ সরকার ও বাকী ৫০ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে ভারত সরকার।