পড়ন্ত বিকেলে এ কান ও কান হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সযতনে গোপন করে রাখা কথাটা-কনসার্টে এলআরবির সঙ্গে গান গাইবেন আইয়ুব বাচ্চুপুত্র আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব। এরপর মানুষদের আর ঠেকায় কে? মুহূর্তেই কানায় কানায় পূর্ণ এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে খোলা মাঠ। সন্ধ্যার আগে আকাশে ওড়া ড্রোন ক্যামেরা দেখাচ্ছিল স্টেডিয়ামের খোলা আকাশের নিচে আর সবুজ ঘাসদের ছিটেফোটারও দেখা নেই; সব কালো কালো মাথা।
আইয়ুব বাচ্চুর ততদিনে তিন হাতের পৃথিবীতে ১২দিন কাটানো হয়ে গেছে। মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পার হওয়ায় ভেবেছিলাম এবিকে ঘিরে আপামর ভক্তদের আবেগ কিছুটা হলেও প্রশমিত ততদিনে। হয়তো শুকাতে শুরু করেছে ভক্তদের চোখের জলও। কিন্তু হঠাৎ মঞ্চে এবি পুত্রকে পেয়ে সেই দর্শকদের চোখে যেন আবারও ফিরে এলো জলের ধারা।
একটা শীর্ষ দৈনিকের হয়ে আমি গিয়েছিলাম সেই কনসার্ট কাভার করতে। যাওয়ার বেলায় অফিস থেকে নির্দেশনা-'এক কলামের ছোট্ট নিউজ হবে, প্রথম পর্ব চাক্ষুস করেই ফিরে এসো।' কিন্তু বিকেলে ফোন করে এবি পুত্রের গান করার বিষয়টি জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা ধরে বসের একের পর এক নির্দেশনা। সঙ্গী জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্র সাংবাদিককেও কড়া নির্দেশনা-'কনসার্ট শেষ হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছেড়ে যাওয়া যাবে না। নানা অ্যাঙ্গেলের ছবি চাই।'
পরদিন 'গাইলেন, কাঁদলেন, কাঁদালেন' শিরোনামে লেখাটা প্রকাশিত হলে অনেকেরই ফোন। যতটা না লেখার রসদগুণে, তার চেয়ে বেশি প্রতিবেদনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটার জন্য-বোনের কাঁধে হাত রেখে গাইছেন আহনাফ, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। গলায় পেঁচানো বাবার বিখ্যাত সেই গিটার।
কোনো রাজনৈতিক পট পরিবর্তন নয়, নয় কোনো দলীয় খুনোখুনি কিংবা মহামারীর শেষ বার্তা। এরপরেও সামান্য একটা কনসার্টের জন্য ডেড লাইনের পরেও পাতা আটকে রাখা, জায়গা রেখে দেওয়া-১০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে প্রথম দেখা। এতে আরেকবার বুঝে যাই-এবি ঠিক কতটা বড় শিল্পী। না হলে তাঁর ডিএনএ বয়ে চলে একটা সদ্য তরুণ, যে কিনা কোনোদিন সেভাবে মঞ্চে গান গায়নি-তাঁর গান গাওয়ার বিষয়টিও এত বড় সংবাদমূল্য। ঠিক এখানেই যেন অন্যদের থেকে আলাদা এবি।
শচীন টেন্ডুলকার যেদিন তার প্রিয় ক্রিকেটজীবন ছেড়ে অবসরের পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছেন তখন অনেকেই বলছিলেন ভারত কিছুটা হলেও পিছিয়ে গেল। কিংবা অপকর্মের দায়ে যখন মোহাম্মদ আশরাফুলের ক্যারিয়ারে 'ফুল স্টপ' পড়ে গেল তখনও ঠিক একই কষ্টের কথা চারপাশে উড়াউড়ি করেছে। কিন্তু বিরাট কোহেলি নামের এক মহাতারকা যেমন ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি সাকিব আল হাসান-লিটন দাসের বাংলাদেশও আগের চেয়ে আরও দুর্দান্ত, দূরন্ত দল। অর্থ্যাৎ যত বড়ই মহীরুহ হোক তাদের জায়গা কেউ না কেউ দখল করে নেয়। কিন্তু এলআরবির দিকে তাকালে?
দেশের শীর্ষ একটা ব্যান্ড, যারা ৩০ বছর ধরে মঞ্চ শাসন করেছে-তারা জাস্ট এবি যেতেই দূরমুশ হয়ে গেল। প্রথমদিকে নিজেদের মধ্যে একজনকে সামনে রেখে চেষ্টা করা হলো; দর্শক নিল না। পরে দেশের আরেক শীর্ষস্থানীয় শিল্পীকে এনে জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা হলো। তাও দর্শক নিল না। শেষমেশ একপ্রকার 'দেউলিয়া।'
দর্শক যেন চিরস্থায়ীভাবে এলআরবির জায়গায় একজনের নামেই হৃদয়ের ভেতর আসন পুতে রেখেছে। তা হলো-'এলআরবি মানেই এবি। এর আগে পরে কেউ নেই।'
স্রেফ একটা মানুষের জন্য বহুবছরের স্বীকৃত একটি দল এভাবে শেষ হয়ে গেছে-হাতের কাছে আর এমন নমুনা পাচ্ছি না। এলআরবির সূর্য হয়তো ডুবে গেছে সেদিনই, যেদিন আইয়ুব বাচ্চু অস্তে গেছেন। মানুষটার সঙ্গেই যেন ব্যান্ডের সমস্ত জনপ্রিয়তাও কবরে চলে গেছে।
বাংলাদেশের ব্যান্ডের প্রবাদপুরুষ অবশ্যই আজম খান। তবে ব্যান্ডের আসল জোয়ার শুরু ৯০ দশকের গোড়াতেই। আর তা অবশ্যই আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে। পরের তিনদশক তাঁকে ঘিরেই
পেকেছে ব্যান্ড সংগীত। অবশ্য জেমসও সমানভাবে উচ্চারিত নাম। তবে ১৫ থেকে ৫০-সব বয়সের মনের কাছাকাছি যেন জায়গা বরাদ্দ একজনের নামেই-তা হলো এবি।
শুধু কী বাংলাদেশের তরুণেরা তাকে সামনে রেখে সমৃদ্ধ হয়েছেন? মোটেও না। ওপার বাংলার ব্যান্ড তারকা রূপম ইসলাম আজও গুরু মানেন আইয়ুব বাচ্চুকে। ক্যারিয়ারের শুরুতে পাওয়া আইয়ুব বাচ্চুর নির্দেশনা-সাহচার্য ভুলতে পারেননা তিনি।
আজ হেডফোনে কান গুঁজে রাখার এই সময়ে যে কটা বাংলা গান বাইরে ভেসে আসে তাঁর সিংহভাগই এবির। এবি মানেই ছিল সুরের মুর্ছনায় আসর জমিয়ে দেওয়া, গিটারের তারে কম্পন ধরিয়ে দেওয়া আর অবশ্যই সামনে হাজারো দর্শকদের হাততালী।
ছোট্ট শহর থেকে উঠে এসে দুনিয়াজোড়া খ্যাতির পর যেদিন কফিনবন্দী হয়ে শেষবারের মতো মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন সেই দিনও দর্শক তাকে ছাড়েনি। কবরের মাটি আপন করে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে এক নজর দেখার জন্য সে কি দীর্ঘ লাইন। অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে পেছনে পাগলা দর্শকদের শোকের মিছিল।
৯০ পরবর্তী তরুণ প্রজন্মের প্রেম শুরু হতো আইয়ুব বাচ্চুর গানে। আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি, তুমি অবসর পাইলে বন্ধু বাসিও-গানের এই কলি চিঠি হয়ে পৌঁছে যেত প্রেমিক/প্রেমিকার দপ্তরে। প্রেমের বয়স বাড়তো তাঁর বাকিগানে। আর বিচ্ছেদে? সেখানেও আশ্চর্যভাবে জড়িয়ে আছেন এবি? এবার বিদায়ের পত্রখানীতে ভর করে পৌঁছে যেত-'সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে, এই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম।'
বাংলাদেশের সংগীত জগতের সর্বাত্মক হাহাকারের সেই ১৮ অক্টোবর আবার ফিরে এলো আমাদের জীবনে। আজও হয়তো দর্শক তাড়া করবেন তাঁকে। ফুলের তোড়া হাতে কেউ হয়তো ছুটবেন চৈতন্যগলি কবরস্থানে। দু হাত তুলে কেউ হয়তো গুণগুণ করে পড়বেন পবিত্র কোরআনের বাণী।
তা দেখে হয়তো মাটির নিচে মায়ের বুকে ঘুমিয়ে থাকা এবি বলবেন-'দেখছো মা, আমি ভক্তদের ছেড়ে আসলেও, আমাকে ভুলে না থাকার অভ্যাস তাঁদের ছেড়ে যায়নি।'
তাসনীম হাসান, সংবাদকর্মী