শোকের চাদরে ঢাকা আগস্ট। জাতির পিতাকে হারানোর শোকে মূহ্যমান জাতির কান্নার মাসও এটি। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উদ্দীপ্ত হওয়ার শোকের বিয়োগাত্মক আখ্যানকে উপজীব্য করে বাঙালি জাতির সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাসও এই আগস্ট। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন সদ্য জন্ম নেওয়া দেশটাকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন সমৃদ্ধি, শান্তি ও সফলতার পথে সেই সময়েই শকুনের কালো থাবায় ইবলিশের প্রেতাত্মা আঘাত হানে লাল-সবুজের পতাকার স্বাধীন মানচিত্রে। এরপর থেকেই উল্টো পথে চলছে স্বদেশ।
কালবৈশাখি ঝড়ের মত মানচিত্রে আঘাত হানে আগস্ট ট্রাজেডির খলনায়ক খন্দকার মোশতাক। মুক্তিযুদ্ধের আশির্বাদে পাওয়া স্বপ্নের সোনার বাংলাকে খামচে ধরে ঘরের শত্রু বিভীষণরূপী ঘৃণিত মোশতাক। সেই কালো রাতে শুধু বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের রক্ত ঝরেনি, রক্ত ঝরেছে মানচিত্রের, পতাকার ও স্বাধীন বাংলাদেশের। যার কারণে গোটা বাঙালি জাতির জীবনের এক অভিশাপের নাম আগস্ট। গা শিউরে উঠা অভিশপ্ত সেই কাল রাতের দৃশ্যকল্পকে ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নামে নাট্যরূপে মঞ্চায়ন করেছে বাংলাদেশ পুলিশ নাট্যদল।
গতকাল সোমবার (১০ জুন) শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে নাটকটির ১৫০তম মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়।
নাটকটির পরতে পরতে বুনিত হয়েছে শোকের কালো সুতায় গাঁথা ইতিহাসের বর্বরতা ও নির্মমতা। কাহিনীর দৃশ্যপটে শুধু কুখ্যাত খুনী খন্দকার মোশতাকের দূরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্রই চিত্রিত হয়নি, পাশাপাশি উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অকৃত্রিম ভালোবাসা, বীরাঙ্গনা গৃহকর্মী পরীবানু, নিরাপত্তা রক্ষী সিদ্দিক ও মুহিতের বিশ্বস্ততা এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের প্রতি তাদের দায় ও ভালোবাসার কথা। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা, অবুঝ শেখ রাসেলকে খুনের পর হায়েনাদের উল্লাসও তুলে ধরা হয়েছে নাটকটিতে।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগ, পরিকল্পনা, গবেষণা ও তথ্যসংকলনে নাটকটির রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন পুলিশ সদর দপ্তরের পরিদর্শক মো. জাহিদুর রহমান।
মোশতাকের স্বপ্নভঙ্গের প্রথম দৃশ্য থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের রক্তে রঞ্জিত ভয়াবহ শেষ দৃশ্যটিও ছিল নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা, আবেগ, ভালোবাসার পাশাপাশি ইতিহাসের জঘন্যতম নরপশু খন্দকার মোশতাকের প্রতি ঘৃণা লক্ষ্যণীয় ছিল প্রতিটি দৃশ্যের বুননে। ইতিহাসের কুখ্যাত খলনায়ক খন্দকার মোশতাকের ঘৃণিত চক্রান্তের স্বপ্নের মাধ্যমেই নাটকের পর্দা উঠে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে খুন করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। স্বপ্নের মাঝেই চিত্রিত হয় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের ট্রাজেডি। ইতিহাসের ঘৃণিত সেই নির্মমতা ও বীভৎসা দেখে ইবলিশের হাসিতে ফেটে পড়ে দেশের ইতিহাসের কলংকিত এই নরপশু। স্বপ্নের মাঝেই প্রতিফলিত হয় তার দূরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত। হঠাৎ কুকুরের শব্দে মানবরূপী এই দানবের ঘুম ভেঙে যায়। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে লেজ গুটিয়ে পালানোর উপক্রম ঘৃণিত এই দুর্বৃত্তের। এই দৃশ্য উপভোগে মিলনায়তনভর্তি দর্শকদের চোখে মুখে মোশতাকের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠেছিল।
এরপর মেজর ডালিম ও রশিদের ষড়যন্ত্র দর্শকদের যেমন ব্যথিত করেছে ঠিক তেমনি বীরাঙ্গনা গৃহকর্মী পরীবানু, পিএস মুহিত ও নিরাপত্তা রক্ষী সিদ্দিকের বিশ্বস্ততার দৃশ্যগুলো আপ্লুত ও শিহরিত করেছিল দর্শকদের। সেই সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের কুটবুদ্ধি, সেনাবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীকে নিয়ে ঘৃণ্য অপপ্রচারের বিভ্রান্তি দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্দেশক মো. জাহিদুর রহমান।
শেষ দৃশ্যে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে খুন ও পরীবানুর আকুতি মিনতির পরও বুলেটের আঘাতে শিশু রাসেলের বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়ার দৃশ্যটি ছিল গা ছম ছম করা ভয়াবহতায় ভরা। অভিনয়শিল্পীদের সংলাপ প্রক্ষেপণ, এক্সপ্রেশন, উচ্চকিত সংলাপের উঠানামা ও প্রতিটি স্টেপেই ছিল পেশাদার অভিনয়ের ছোঁয়া। লাইট, সাউন্ড ইফেক্ট, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকসহ নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রেই মুন্সীয়ানার ছাপ রেখেছেন নির্দেশক জাহিদুর রহমান। শিক্ষণীয় বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিটি দৃশ্যকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছিলেন নাটকটির রচয়িতা ও নির্দেশক। শিল্পী ও নির্দেশকের পারদর্শিতায় ফুটে উঠেছিল পেশাদারিত্বের ছাপ। সকল শ্রেণীর মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার প্রত্যয়ে নাটকের সংলাপে ও অভিনয়ে ছিল সহজ-সরল ও সাবলীলতার ছাপ। নির্দেশনার প্রতিটি বিভাগের কারুকাজে দক্ষতার পাশাপাশি খন্দকার মোশতাক চরিত্রেও অনবদ্য অভিনয় করেছেন মো. জাহিদুর রহমান।
‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নাটকটি নিয়ে ডি আই জি হাবিবুর রহমান বলেন, শোকাবহ আগস্টকে জাতির সামনে শৈল্পিকভাবে তুলে ধরতে প্রায় এক দশক আগে থেকেই নানা পরিকল্পনা করছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথেই কথা বলেছিলাম। কিন্তু কোন মনঃপূত কিছু না পাওয়াতে অবশেষে পুলিশ নাট্যদলকেই দায়িত্ব দিলাম। সমাজের অপরাধ দমনের পাশাপাশি অভিনয় ও নির্দেশনার নানা কাজে পুলিশ বাহিনী যে কারো চেয়ে কোন অংশে কম নয় তাই বোঝা যাচ্ছে নাটকটি নির্মাণের পর। দর্শকদের দ্বারা প্রশংসিত হওয়ার কারণে মাত্র এক বছরে আমরা নাটকটির শততম মঞ্চায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। এটি এদেশের নাটকের ইতিহাসে অনন্য রেকর্ড। দর্শক না চাইলে আমরা এত তাড়াতাড়ি শততম মঞ্চায়নের রেকর্ড অর্জন করতে সক্ষম হতাম না। রাজারবাগের পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমিসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নাটকটি মঞ্চায়ন হয়েছে বলেও জানান তিনি।
কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও ত্যাগ এবং বিকৃত ইতিহাসের কালো থাবা থেকে জাতিকে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নাটকটি প্রযোজনার সিদ্ধান্ত নিই আমরা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও আগ্রহের কারণেই এই নাটকটি আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি ঘটিয়েছে।
নির্দেশক মো. জাহিদুর রহমান বলেন, শিক্ষণীয় বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি সবশ্রেণীর মানুষের সামনে নাটকটিকে উপভোগ্য করে তোলার জন্য প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ধারা থেকে বের হয়ে নতুনত্ব এনে নাটকটির নির্মাণে আমি ভিন্ন প্রথা অবলম্বন করেছি। আমি চেয়েছি সবশ্রেণীর মানুষের নিকট নাটকটি বোধগম্য হোক। নাটকটিকে দর্শকদের কাছে উপভোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলার জন্য প্রথাগত নিয়ম ভেঙে নাটকটিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছি। নাটকটিতে বঙ্গবন্ধু, বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ও শেখ রাসেলকে রূপক অর্থে তুলে ধরে ভিন্ন রকমের একটা এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছি। ডি আই জি হাবিব স্যার আমাকে এত বড় সুযোগ দেওয়াতে আমি উনার প্রতি আন্তরিকভাবে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ। এই প্রযোজনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা না থাকলে এত বড় কাজ সম্ভব হতো না।
এর আগে শিল্পীদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান ও লাকী ইনাম। এরপর পুলিশ থিয়েটারকে ফুলেল শুভেচছায় সিক্ত করেন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।