প্রায় প্রতিদিনের মতো আজও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ফেসবুকে চলমান ঘটনা নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার আজকের বিষয়, ‘চলচ্চিত্রবিষয়ক কমিটি’। এক কথায় বলতে গেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আওতায় সম্প্রতি গঠিত হওয়া চলচ্চিত্র বিষয়ক যতগুলো কমিটি হয়েছে তার গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন এই নির্মাতা।
বলে রাখা ভালো, এই কমিটিগুলোতে মূলত ফারুকীর অনেক কাছের মানুষজন রয়েছেন। তারপরও তিনি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে কমিটিগুলোর সমালোচনা করায় পোস্টের কমেন্ট বক্সে তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকেই।
ফারুকী লিখেছন, ‘‘চলচ্চিত্রবিষয়ক যতগুলো কমিটি হয়েছে তার মধ্যে ‘পরামর্শক’ কমিটিই আমার বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো হয়েছে। বাকী কমিটিগুলোতে (চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জুরি বোর্ড, শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদানের স্ক্রিপ্ট বাছাই কমিটিসহ একাধিক কমিটি সম্প্রতি গঠিত হয়েছে) যোগ্য লোক যেমন আছে, কিছু বিস্ময়কর নামও আছে। এই সমালোচনাটা করে রাখা দরকার যাতে সরকার বুঝতে পারে। না হলে আগের আমলের মতো ‘কর্তা যা করেছেন মাইরি’ সিচুয়েশন বানিয়ে ফেলবো আমরা।’’
এইসব কমিটিতে আরও কারা থাকতে পারতো না উল্লেখ করে ফারুকী লিখেছেন, ‘আমার বিবেচনায় এখানে আরো কিছু অংশীজন থাকা উচিত ছিলো। যেমন ফাহমিদুল হক, বিধান রিবেরু, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মেজবাউর রহমান সুমন, নুহাশ হুমায়ুন। স্বচ্ছতার জন্য বলে নেয়া ভালো, আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিলো পরামর্শক এবং আরেকটা কমিটিতে থাকার জন্য। আমি ব্যক্তিগত কারণে থাকতে চাইনি। এখন যাদের নাম উল্লেখ করলাম তারা থাকতে অপারগতা জানিয়েছে কিনা আমি জানি না।’
তিনি আরও লেখেন, ‘আমার বক্তব্য থাকবে- এই পরামর্শক কমিটি থেকে পরামর্শ যা যাবে তা যেনো অংশীজনরাই তৈরি করে দেন। সরকারী কর্মকর্তারা কেবল এক্সিকিউশনের দিকটা দেখা উচিত। নীতি প্রণয়নে তারা হাত না দেয়াই ভালো হবে কারন তারাতো আমাদের সমস্যা এবং প্রয়োজনটা জানেন না।’
এরপর কিছু পরামর্শ দিয়েছেন এই নির্মাতা। তিনি লিখেছেন, ‘এখানে আরেকটা কথা যোগ করতে চাই। শিল্পকলা একাডেমির জমি আছে মোটামুটি দেশ জুড়েই। কমপক্ষে ৩০ জেলায় শিল্পকলার জায়গায় মাল্টিপ্লেক্স করে সেটা দরপত্রের ভিত্তিতে প্রাইভেট ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। যেহেতু আমাদের জাতিগত দুর্নাম ‘আমরা শুরু করি, অব্যাহত রাখি না’, সেহেতু এই সব মাল্টিপ্লেক্সকে মনিটরিংয়ে রাখতে হবে এর মেইনটেনেন্স ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। না হলে লিজ বাতিলের শর্ত থাকতে হবে। এখন ঝামেলা হলো শিল্পকলা সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের অধীন আর সিনেমা-টিভি-ওটিটি তথ্য ও সম্প্রচারে। এই দুই মন্ত্রনালয়ের সমন্বয় করে হলেও এটা করা দরকার।’
ফারুকী যেহেতু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্জার করেছেন তারই প্রেক্ষিতে লিখেছেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটা হচ্ছে ফিল্ম ফান্ড এবং সাপোর্ট সিস্টেম। আমাদের সামনে বুসান, সানড্যান্স, বার্লিন, রটারডাম, ফিল্মবাজার স্ক্রিন রাইটার্স ল্যাবের উদাহরণ আছে। আমি মনে করি পরামর্শক কমিটির উচিত অনুদান প্রথাতে আমূল পরিবর্তন আনা। ৫০ ভাগ ছবি ফার্স্ট এন্ড সেকেন্ড টাইম ফিল্মমেকারদের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত। এই ৫০ ভাগের মাঝে কমপক্ষে অর্ধেক নারী ফিল্মমেকারদের জন্য থাকা উচিত। তো এই নতুন পরিচালকদের স্রেফ ফান্ড দিয়েই হাত গুটিয়ে ফেলা যাবে না। স্ক্রিন ল্যাবের মতো ইনকিউবিটরে লোকাল এবং ইন্টারন্যাশনাল মেন্টর দিয়ে এদের সহায়তা করতে হবে।’
পাশাপাশি অনুদান পলিসি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার পরামর্শ ফারুকীর। তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘আমরা কোন ধরনের ছবিকে অনুদান দিবো? ইরানের মতো সোশ্যালি রিলেভ্যান্ট এবং ইমপ্যাক্টফুল স্টোরিটোলিং? নাকি কোলকাতা আর্টহাউজের দুর্বল ফটোকপি? নাকি বেলা তারের মতো ছবি? আমার বিবেচনা হচ্ছে আমাদের এখানকার মানুষ, তাদের সম্পর্ক, আবেগ, পাগলামো এসব মিলিয়ে আমাদের আশেপাশে নিজস্ব গল্প এবং চরিত্রেরা হেঁটে বেড়াচ্ছে। এইসব নিয়ে সোশ্যালি রিলেভ্যান্ট ছবির সংখ্যা বাড়লেই আমরা সত্যিকারের বাংলাদেশী নিউ ওয়েভ হতে পারবো।
একই সাথে পরামর্শক কমিটির উচিত অনুদান কমিটি পূনর্গঠন করা। নতুন পলিসির আলোকে যারা এটা এক্সিকিউট করতে পারবে তাদের রাখা উচিত। দেখেন ব্যক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন যে অনুদান কমিটি করা হয়েছে সেখানে এক দুই জন যোগ্য লোক থাকলেও এটা অনেকটাই আওয়ামী লীগ আমলের মতোই ব্যাকডেটেড কমিটি। আর এই কমিটির কে কিভাবে ফ্যাসিবাদের কালচারাল উইংয়ের ফুটসোলজার ছিলো সেই আলাপে গেলাম না।
আমি মনে করি এই কমিটিতে থাকা উচিত ছিলো তাদের যাদের সারা দুনিয়ায় এই কাজগুলো কিভাবে হচ্ছে সেটার ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা আছে। বিদ্যমান কমিটির যোগ্য দুয়েকজনের পাশাপাশি আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, নুহাশ হুমায়ুন, আরিফুর রহমান, তানভীর হোসেন, সালেহ সোবহান অনীম, আদনান আল রাজীব, কামার আহমেদ সায়মন, হোমায়রা বিলকিস এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ থাকলে আমরা একটা ফরওয়ার্ড লুকিং ভিশন পেতাম।
অনেকে ভাবতে পারেন আমি ব্যক্তির উপর কেনো গুরুত্ব দিচ্ছি। দিচ্ছি কারণ ব্যক্তির কারনেই আকাশ পাতাল পার্থক্য রচিত হয়। মোহাম্মদ আযম আর মিডিওকার কোনো রাম-শ্যাম এক জিনিস না। সৈয়দ জামিল আহমেদ আর লাকী এক জিনিস না।’