কলকাতায় ঊর্মি রহমান সরব জীবন কাটাচ্ছেন। বাঙালির সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসবের নানা আয়োজনে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন তিনি। পহেলা বৈশাখের ব্যাপক অনুষ্ঠানমালার ব্যস্ততার পাশাপাশি সাংবাৎসরিক নানা সামাজিক উদ্যোগে মেতে আছেন এই মানুষটি। নিবিড় ভাবে সংশ্লিষ্ট আছেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ গ্রুপের সঙ্গে।
বাংলাদেশের সত্তর ও আশির দশকের লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষই ঊর্মি রহমানকে চেনেন। তাঁর ব্যক্তিগত বা পেশাগত নৈকট্য পেয়েছেন অনেকেই। সে সময়ের বাংলাদেশে তাঁর উজ্জ্বল তৎপরতার কথা বিস্মৃত হওয়ার মতো নয়।
লেখালেখির কারণে ছিলেন পাঠকের প্রিয়। তৎকালের গুরুত্বপূর্ণ সাপ্তাহিক, অধুনালুপ্ত ‘বিচিত্রা’র নিয়মিত লেখক-সাংবাদিক ছিলেন তিনি। তারপর আচমকাই চলে গেলেন বিলাতে, ‘বিবিসি’তে। লেখার বদলে লন্ডন থেকে ইথারে ভেসে আসা তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেছেন সহস্র শ্রোতা। সেখানেও থিতু হলেন না। ইচ্ছে করলেই স্থায়ী বসবাস গড়তে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চলে এলেন বাঙালির আরেক প্রিয় শহর কলকাতায়। দক্ষিণ কলকাতার সাউথ সিটিতে গগনচুম্বী এক নান্দনিক অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করছেন তিনি।
মনে হয় বিশ্বায়নের জাতিকা হয়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরছেন ঊর্মি রহমান। তথাপি বাংলা ও বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সংযোগ অমোচনীয়। ঢাকার শিল্প-সাহিত্য-সাংবাদিকতার সকল খবরই জানতে চেষ্টা করেন। সাইবার যোগাযোগের কারণে তথ্যের আদান-প্রদান আজকাল আরও সহজ। বার্তা২৪.কমের নবযাত্রার কথা জেনে বলেন, ‘এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন আমার ঘনিষ্ট। তাঁকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।’
বহু বছর পর তাঁর সঙ্গে আবার দেখা করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে আমার সম্ভাব্য কলকাতা ভ্রমণের কারণে। জানালেন, ‘এখন নাতিদের কাছে লন্ডনে আছি। অক্টোবরের মাঝামাঝি ফিরে আসবো কলকাতায়। তখন যদি থাকেন তো দেখা হবে।’ আমিও অপেক্ষায় থাকি বৃক্ষবহুল দক্ষিণ কলকাতার কোনও এক রেস্তরাঁয় এক পেয়ালা চা কিংবা কফি হাতে তাঁর মুখোমুখো হওয়ার।
কবুল করাই শ্রেয় যে, তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ অবশ্যই আনন্দের অভিজ্ঞতা। যেমনটি আমার একবারই হয়েছিল নব্বই দশকের সূচনায়। তখন তিনি বাংলাদেশ-পর্ব শেষে লন্ডন প্রবাসী। ‘বিবিসি’র পক্ষ থেকে ঢাকায় এসেছেন ইংরেজি শিক্ষার অনুষ্ঠান ‘টাইগার্স আই’ নিয়ে। পুরো অনুষ্ঠানের একটি ক্যাসেট (তখন সিডি’র জন্ম হয় নি) আর অনুষ্ঠানের পুরোটা নিয়ে একটি বইয়ের ছাপানো ভার্সন উন্মোচন হয়েছিল সে আমলের হোটেল শেরাটনে। মিডিয়ার মাধ্যমে ভাষার শিক্ষা কোনও প্রকল্প সম্ভবত সেটিই ছিল প্রথম। বেতারে ও প্রকাশিত আকারে ‘টাইগার্স আই’ অসম্ভব সাড়া জাগিয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়বস্তু, চরিত্র ও প্রেক্ষাপট ব্যবহার করে ইংরেজি শেখানোর ক্ষেত্রে বিবিসি’র সে উদ্যোগকে বলা যায় পথিকৃৎ। ‘বিবিসি’র পক্ষে সেটি প্রয়োজনা করেছিলেন সাগর চৌধুরী।
‘টাইগার্স আই’ নিয়ে বেশ কয়েকদিন ঊর্মি রহমান ঢাকায় ছিলেন। সে সময় আনুষ্ঠানিক আয়োজনের বাইরে একটি দীর্ঘ সন্ধ্যা ঊর্মি-সাগরের সান্নিধ্যে কাটে বনানীর এক বাড়িতে। বনানী পোস্ট অফিসের পেছনের দিকে বাড়িটি ছিল ঊর্মি রহমানের এক আত্মীয়ের, সম্ভবত বোনের। অনেক কথা হয়েছিলে এই যুগলের সঙ্গে নানা বিষয়ে ও প্রসঙ্গে।
তারপর বহু বছর আর দেখা নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে ভার্চুয়াল স্পেসে কথা-বার্তা হয়। তথ্যের আদান-প্রদান চলে। বার্তা২৪.কমে লিখতে বললে রাজি হন। বার্তায় প্রকাশিত আমার লেখা পড়ে মুদ্রণ প্রমাদ ধরতে কসুর করেন না বাংলা সাহিত্যের এই তুখোড় ছাত্রীটি। কাছের ঊর্মি রহমান এক ও অনন্য হয়েই থাকেন দূরত্বের সীমানা ডিঙিয়ে।
কাছেরই তো! ফরিদপুর অঞ্চলের যে তরুণী রাজধানী শহরের আজিমপুরে বড় হয়েছেন ঢাকার বিখ্যাত স্কুল-কলেজে পড়ে, তিনি এই শহর, এই জনপদের সবচেয়ে কাছের একজন তো বটেই। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আবার ঢাকায় সাংবাদিকতা করেছেন, শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে মিলেমিশে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক বাংলাভাষীর পরিমণ্ডলে। এখন বসবাস করছেন বাংলারই আরেক ভূগোল কলকাতায়। তাঁর চেয়ে বাংলা ও বাঙালির কাছের জন আর কে!
আমাদের ঊর্মি রহমান ভৌগোলিক দূরত্বের আরেক শহরে আছেন, সত্যটি আমাদের জন্য বেদনার ও কষ্টের। কিন্তু ঊর্মি রহমান সর্বাবস্থায় বাংলা ও বাঙালিকে নিয়ে আছেন, এই পরম সত্যটি সকল কষ্ট ও বেদনার উপশম। অনন্য আনন্দের সুশোভন অভিঘাত হয়ে জীবনে ও কর্মে ঊর্মি রহমান রয়েছেন বাংলার ও বাঙালিরই।