বাংলাদেশ এগিয়েছে ও পিছিয়েছে যেসব খাতে

, ফিচার

দেবদুলাল মুন্না | 2023-09-01 21:18:10

এ লেখাটি তৈরি করতে বেশ কিছু রিপোর্টের সাহায্য নিতে হয়েছে। সব রিপোর্ট গুলো যে নিরপেক্ষ সমীক্ষা চালিয়েছে এমনটি ভাবার কারণ নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই কিছু  ‘হিডেন উদ্দেশ্য’ থাকে।

দেশ স্বাধীনের পর ৫০ বছরে এসেও বাংলাদেশ উদার গণতান্ত্রিক সূচকে ভাল অবস্থানে নেই। ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৪তম। এমনকি নির্বাচনী ব্যবস্থাও নিরপেক্ষ নয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের ‘রুল অব ল ইনডেক্স’ এর রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আরও জানানো হয়, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ সালের পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে এ রিপোর্ট দিয়েছে সংস্থাটি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্প্রতি কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেশ কিছু তথাকথিত নিরপেক্ষ সংস্থার হিসেবমতে বাংলাদেশের সাফল্যও অনেক বেশি। উন্নয়ন হচ্ছে। যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ সফল।  

এছাড়া অন্তত ১৩টি খাতে বিশ্বে গৌরবোজ্জ্বল অবস্থান তৈরি করেছে। এসব খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের মতো বড় দেশের পরেই উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম। কয়েকটি ক্ষেত্রে তো চীন-ভারতকে পেছনে ফেলে প্রথম অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ১৩টি খাতে দেশে সাফল্যের ধারা অব্যাহত আছে।

বিশ্বে মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে,। চারবছর আগে হতো  তবে  ৬৫ শতাংশ। গত দুইবছরে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। ইলিশ উৎপাদনে ভারত দ্বিতীয়, মিয়ানমার তৃতীয়। এ ছাড়া ইরান, ইরাক, কুয়েত, পাকিস্তানেও সামান্য ইলিশ উৎপাদন হয়। পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২ হাজার ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা বিশ্বের মোট পোশাক রপ্তানির ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। পোশাক রপ্তানিতে প্রথম হচ্ছে চীন। একসময় বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম এগিয়ে ছিল। রেমিট্যান্স আহরণে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। গত অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার। একই অর্থবছরে ভারত ৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার নিয়ে প্রথম এবং ৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলার পেয়ে চীন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় ও ধান উৎপাদনে চার নাম্বার অবস্থানে রয়েছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিভাগ কৃষিখাতের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেছে।

আম, কাঠাল, পেয়ারা রুপ্তানি করেও আয় হচ্ছে ভাল। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। নদ-নদীর খারাপ অবস্থা সত্ত্বেও এফএওর মতে,আগামী বছর বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। গত ১০ বছরে মাছের উৎপাদন ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। আর মাছ রপ্তানি বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। আউটসোর্সিং এ ভাল করছে শিক্ষিত তরুণ তরুণীরা। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছয় লাখ, যা শতকরা হারে বিশ্বের প্রায় ২৭ শতাংশ। এ মন্ত্রণালয় দাবি করছে,  বাংলাদেশ এ খাতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যায় প্রথম হচ্ছে ভারত।

যদিও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওকলার ‘স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স’র মতে, ইন্টারনেটের গতির ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫ নম্বরে। পেছনে রয়েছে আফগানিস্তান এবং ভেনেজুয়েলা। বিশ্বের প্রধান সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক প্রকাশিত ‘ডিজিটাল কোয়ালিটি অব লাইফ ইনডেক্স ২০২১’ ডিজিটাল জীবনযাত্রার সূচকে ১১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৩তম।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল প্রথম পাঁচটি দেশের তালিকায় রয়েছে। জলবায়ুর ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ নামের শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের অমীমাংসিত স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে ছিটমহলের মানুষ অভিশপ্ত জীবনে মুক্তির আস্বাদ পেয়েছে। ১১১টি ছিটমহলের ১৭ হাজার ৮৫১ একর জায়গা বাংলাদেশের সীমানায় যুক্ত হয়েছে। সমুদ্রসীমায়ও প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৯৮ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা যুক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের প্রতিবেদন মতে, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩৯টি দেশের ৬৪ শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ যাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়ে। কিন্তু ঠিক কতো নাম্বারে বলা হয়নি।

বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজন, যার ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সাথে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ৩৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ৩৫ লক্ষ গ্রাহককে।নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ৬৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বদনামও কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় নেই, হচ্ছে ধারাবাহিক অবনতি।এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে না কোন গবেষণা বলে দাবি করেছে বিশ্ব শিক্ষা উন্নয়ন সংস্থা ( ডব্লিউএডেও ) । যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) সর্বশেষ হিসাবেও তাই বলা হয়েছে। বিশ্বের ১ হাজার ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে। অথচ ২০১২ সালেও ৬০১তম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৫ সালে ছিল ৪০৭।

করোনার কারণে বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে, ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। তবে, সংক্রমণ কমে আসায় বছরের শেষদিকে সীমিত পরিসরে হয়েছে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা। ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশ করা হয় ২০২০ সালের এইচএসসি অটোপাসের ফল। করোনা মহামারির কারণে হয়নি এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। জেএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ২৫ শতাংশ ও এসএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ৭৫ শতাংশের যোগফলের ভিত্তিতে এইচএসসি‘র অটোপাসের ফল প্রকাশ করা হয়।সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলেছে ও পরীক্ষা হচ্ছে। পাঠদানও চলছে।২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে দেশের ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে।

বিশ্বে পাসপোর্টের মান নির্ধারণকারী সূচক ‘হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স-২০২১’ সূচকের মোট ১১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৮তম স্থানে রয়েছে। ২০০৭ সালের ৬৮তম অবস্থান থেকে ক্রমশ অবনতি ঘটছে এ বিষয়েও। বিশ্বব্যাংকের মতে, ১৪০টি মেগাসিটির মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৮তম। ট্র্যাফিক জ্যামের শিকার ৯১ শতাংশ মানুষ।আর রাজধানীর ৭১ শতাংশ মানুষ ডিপ্রেসনে ভোগেন।

ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য সেটি হলো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকাশিত গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট ২০২০-২১-এ জানানো হয়েছে, এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যূনতম মজুরিতে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে,নারী নির্যাতন বেড়েছে। স্ত্রী নির্যাতনের সূচকে  বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। বাল্যবিয়ে তেও চতুর্থ। যৌন সহিংসতায় ঢাকা বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে এবং  নারীর প্রতি আরও সহিংসতা আরও বাড়বে বলে মনে করে সংস্থাটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলছে, চিকিৎসাব্যয় মেটাতে মানুষ আরও গরিব হচ্ছে। প্রতিবছর ১ কোটি ১৪ লাখের মতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার জিডিপির মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ খরচ করে স্বাস্থ্য খাতে, যা বৈশ্বিক তলানিতে। এছাড়া স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর মতে, দুর্নীতিবাজদের ঘুষের পাতা ফাঁদ সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। দুর্নীতিবাজদের কারণে দেশের ৭৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই ঘোষিত ওই প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ পায়নি।

আইকিউএয়ারের বায়ুমান সূচক অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ দূষিত ১০০ শহরের মধ্যে ঢাকা শহরের অবস্থান তিন নম্বরে। এফএও’র ‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ফরেস্ট-২০১৬’ প্রতিবেদনে মতে, বনভুমি উজাড় হচ্ছে বেশি।

করাচির গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট অব হিস্টোরিকাল এবং সোশ্যাল রিসার্চের পরিচালক ড. সৈয়দ জাফর আহমেদ বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৯৭১ নিয়ে পাকিস্তানে সরকারি ব্যাখ্যা গত ৫০ বছরে তেমন বদলায়নি।কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ অনেক খাতে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এবং পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই) সাবেক প্রধান লে. জে. (অবসরপ্রাপ্ত) আসাদ দুররানি বিবিসিকে বলেন, গত ৫০ বছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি না এলেও পাকিস্তানের মানুষ এখন অনেকটাই বুঝতে পারছে কোথায় গলদ হয়েছিল।মানুষের মনে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে ভুল হয়েছিল। সেনাবাহিনীর ভুল হয়েছিল। নির্বাচনের পর (সত্তরের নির্বাচন) শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব মেনে না নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো ভুল করেছিলেন।

লেখক পরিচিতি: কথাসাহিত্যিক সিনিয়র সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর