ফিরে দেখা: রাহুমুক্তির সেই দিন

  • আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বাঙালির স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের সুপ্ত আকাঙ্খা বহু যুগের। নিষ্পেষিত এ জাতি মুক্তির জন্য একাত্তরের মতো নিরঙ্কুশ ঐক্য আগে কখনো গড়তে পেরেছিল বলে শোনা যায় না। নয় মাসের রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার।

৫৩ বছর পেরিয়ে বাঙালির রাহুমুক্তির সেই দিনটি কেমন ছিল তা জানার আগ্রহ অনেকেরই। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বরের সংবাদপত্রে বিজয় অর্জনের বিবরণ নানা আঙ্গিকে তুলে ধরেছিল সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলো। মর্মস্পর্শী সেই বিবরণ না পড়ে থাকলে ইতিহাসের সত্যিকারের পাঠ অপূর্ণই থেকে যায়। আমরা জেনে নেওয়া চেষ্টা করব, কিভাবে চিত্রিত হয়েছিল বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দিনটি।

বিজ্ঞাপন

‘মুখর মহাকাল’ শিরোনামে বিশেষ রচনায় দৈনিক সংবাদ লেখে, ‌‌‘বহু কালো রাত্রির তমিস্রা বিনাশ করে আজ অপরাহ্নে মহানগরী ঢাকায় মানবতার বিজয় পতাকা উড্ডীন হোল। চক্রান্তের যাবতীয় ঘৃণ্য জাল ছিন্ন করে দেখা দিল্ল অম্লান প্রভাব। একদিন অপরাহ্নে বাংলার প্রান্তরে মীরজাফরের চক্রান্তে যে সূর্য ডুবেছিল, আজ আ এক অপরাহ্নে চতুর্দিক আলোকিত করে সেই সূর্য আকাশে উঠল।’

‘বহু মাতার, বহ ভগ্নীর সম্মান যারা কেড়ে নিয়েছে, বহু তরুণের উষ্ণ রক্তস্রোতে যারােএকদিন স্নান করেছে, বহু গৃহের প্রাঙ্গনে যারা এতদিন শোষণের বিষ বৃক্ষ রোপণ করেছে, সমগ্র মানব জাতির সঞ্চিত সভ্যতাকে যারা কলঙ্কিত করেছে-তারা ঢাকার প্রান্তরে নতজানু...আজ হৃদপিণ্ডের আহ্বান-হে বিশ্ব শোন, আমি সুপ্ত ছিলাম কোটি প্রাণে, আজ আমি বিকশিত। আজ শতাব্দির অভিশাপ মুছে গেল, আজ বিজয়ের পর লগ্নে বন্ধুকে আলিঙ্গন দেবার জন্য এবং শত্রুকে আঘাত দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’-ত্রিপুরার সংবাদের বিশেষ সম্পাদকীয়তে এভাবেই চিত্রিত হয়েছিল সেই দিনের আখ্যান।

বিজ্ঞাপন

সে এক ইতিহাস

দৈনিক ইত্তেফাক ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংখ্যায় বিজয় দিবসের বিবরণ প্রকাশ করে ‌‌‌‌‌‌‌‘আত্মসমর্পণ’-সে এক ইতিহাস। বিগত কয়েকদিন যাবৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে পর পর মিত্র বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর নিকট পরাজয়বরণের পর দখলদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল আমীর আবদুল্লা খান নিয়াজী গত বুধবার বিকালে নয়াদিল্লিস্থ আমেরিকান দূতাবাসের মারফত ভারতের সর্বাধিনায়ক জেনারেল শ্যাম মানেকশ’ন নিকট যুদ্ধিবিরতির প্রস্তাব পাঠান। তদনুযায়ী জেনারেল মানেকশ বুধবার বিকাল ৫টা হইতে গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকায় বিমান আক্রমণ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন এবং জেনারেল নিয়াজী যাতে কলকাতায় যোগাযোগ করিতে পারেন তজ্জন্য দুইটি রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি প্রদান করেন। তদনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় লেঃ জেনারেল নিয়াজী কলিকাতায় রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি মারফত যোগাযোগ করেন। এই যোগাযোগের পর আত্মসমর্পণের শর্তাবলী আলোচনার জন্য বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টা নাগাদ লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা হেলিকপ্টার যোগে ঢাকায় আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার। রমনার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টা ১ মিনিটে জেনারেল নিয়াজী বিনাশর্তে আত্মসমর্পনের দলিল স্বাক্ষর করেন উপস্থিত বিপুল জনতার মুহুর্মূহু জয়বাংলা ধ্বনির মধ্য দিয়ে।

যা বলেছিলেন সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দিন

বিজয় অর্জনের প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘আজ (শুক্রবার)বাংলাদেশ বেতার হইতে প্রদত্ত এক ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ফলে আমাদের সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হইয়াছে।’

‘জনাব তাজউদ্দিন আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করিলেও আমাদের সংগ্রাম শেষ হয় নাই। এক্ষণে এদেশকে পুনর্গঠনের জন্য আরো ঐক্য ও আত্মত্যাগের জন্য তৈয়ার থাকিতে হইবে।’

অপরদিকে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সশস্ত্র সংগ্রাম শেষ হইয়াছে। আর এক সংগ্রাম বাংলোদেশ গঠনের।’

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের এক নোটিশে বলা হয়, সকল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রতি অবিলম্বে ঢাকায় ইপিআর হেডকোয়ার্টারে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের কোন জায়গায় গোলাগুলি না করার জন্য অনুরোধ করা যাইতেছে। আমরা স্বাধীনতা পাইয়াছি, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখিতে হইবে। -এগুলোই হচ্ছে ইত্তেফাকে প্রকাশিত কিছু বিবরণের খণ্ডচিত্র।

১৬ ডিসেম্বরের ঘটনাবহুল পরিস্থিতির বিবরণ প্রকাশ করেছে দ্য অবজারভার। দৈনিকটি শিরোনাম করেছিল, ‌‌‌‌‌‌ড্রিম অব সেভেন্ট্রি ফাইভ মিলিয়ন হিরোইক পিপল/বাংলাদেশ কামস ট্রু। সেদিন ‘বার্থ অব এ নিউ নেশন’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল দৈনিকটি।

‌‘আত্মত্যাগে তৈয়ার থাকিতে হইবে’

দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ জনগণকে সতর্ক করে যে মন্তব্য করেছিলেন তা বিদায়ী বছর ২০২৪-এর বিজয় দিবসে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলেই ধরে নেওয়া যায়। বিজয় দিবস কি শুধু ফুল দিয়ে শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ? একাত্তরের এ বিজয় আমাদের কাঁধে এক হিমালয়সমান কর্তব্যভার নিয়ে আসেনি? দেশের পুনর্গঠনে ঐক্য ও ত্যাগের যে তাগিদ তাজউদ্দিন আহমদ দিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সে পথে হাটেনি। বলা যায় যে হাটতে দেওয়া হয়নি।

মহান মুক্তিযুদ্ধে শোষণহীন রাষ্ট্রের জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু গেল ৫৩ বছরে আমরা বাংলাদেশ থেকে শোষণের মুলোৎপাটন না করে বৈষম্যকেই ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছি। নবযুগের যে আহ্বান আমরা চারপশে ধ্বনিত হতে শুনছি, সেখানে দেশের জন্য নিজের অবস্থান থেকেই আত্মত্যাগে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র রক্তে স্নাত ভূমি থেকে সব ধরণের বঞ্চনা ও বৈষম্য যেদিন দূরীভূত হবে, সেদিনই এই বিজয় দিবস উদযাপন পূর্ণতা পাবে।