ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্ম সম্মান’। ১৯৫৪ সালের ২ জানুয়ারি ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পদ্ম সম্মানের প্রবর্তন হয়। জাতির প্রতি বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই পদ্ম সম্মান প্রদান করে থাকে ভারত সরকার। পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী এই তিন বিভাগে দেওয়া হয় পুরস্কারগুলো।
চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন পদ্ম সম্মান প্রাপকদের তালিকা। সে তালিকা থেকে এবছর পদ্মভূষণ সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজেই এক বিবৃতি দিয়ে জানান, ‘পদ্মভূষণ পুরস্কার নিয়ে আমি কিছুই জানি না। আমাকে এ নিয়ে কেউ কিছু বলেওনি। যদি আমাকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দিয়ে থাকে, তাহলে আমি তা প্রত্যাখ্যান করছি।’
শুধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ই নয় এবছর পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরকারের দেওয়া পদ্ম সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনজন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট তবলাবাদক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।
পদ্ম সম্মান প্রত্যাখ্যানের শুরু হয়েছিল নাট্য ব্যক্তিত্ব শিশিরকুমার ভাদুরির মাধ্যমে। কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের মনে হয়ছিল বাংলার বিশিষ্ট এই ব্যক্তিত্বকে পদ্ম সম্মান দেওয়া দরকার। আর শিশির ভাদুরির বয়স তখন ৭০ বছর। সরকারের দেওয়া সম্মান নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নাট্যমঞ্চের বিশিষ্ট এই শিল্পী বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সম্মান আসলে স্তাবকের দল তৈরির এটা চেষ্টামাত্র।‘
তারপর থেকে কয়েকদশক ধরে বাংলার বহু বিশিষ্টজন পদ্ম সম্মান সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
১৯৯০ সালে পদ্মভূষণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী। সেই সময়ে কেন্দ্রে আসীন কংগ্রেস সরকার। কেন্দ্রকে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, একজন সাংবাদিকের ওপর রাষ্ট্রের বদান্যতার বোঝা থাকা উচিত নয়।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের মতো পদ্ম সম্মাননা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পশ্চিম বাংলার স্বর্ণযুগের শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৮৮ সালে কেন্দ্রের তরফ থেকে বিশিষ্ট এই শিল্পীকে পদ্ম সম্মান দেওয়া হলে তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
একাধিকবার পদ্ম সম্মাননা ফিরিয়ে দিয়েছেন পশ্চিম বাংলার নাট্যকার বাদল সরকার। তাকে প্রথমবার ১৯৭২ সালে দেওয়া হয়েছিল পদ্মশ্রী। তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার চার বছর আগে বাদল সরকার পেয়েছিলেন সঙ্গীত-নাটক একাডেমি সম্মান। বাদল সরকার বলেন, লেখক হিসেবে তিনি তার প্রাপ্য সম্মান পেয়ে গিয়েছেন। তার আর নতুন করে কোন সম্মানের প্রয়োজন নেই।
শুধু ব্যতিক্রমী হয়ে রইলেন ভারতীয় বিশিষ্ট অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৭০ সালে পদ্ম সম্মাননা ফিরিয়ে দিয়ে তিনি তার চেয়েও আরও উচ্চতর সম্মান গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালে তিনি পদ্মভূষণ সম্মাননা গ্রহণ করে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, এই সম্মান না নিলে ভক্তদের ভাবাবেগে আঘাত লাগবে।
‘বলো বীর, চির উন্নত মম শির’
পদ্ম সম্মাননা প্রত্যাখ্যানের ঝড় দেখে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার কথাই বারবার মনে পড়ে। যারাই এই সম্মাননা প্রত্যাখান করেছেন তাদের কথায় এমনটাই মনে হয় একটি সম্মান পাওয়ার লোভে নিজের মান-সম্মানকে কোনভাবেই বিসর্জন দেওয়া যায় না।