হাওড়া (কলকাতা) থেকে: যে স্বাতন্ত্র্য বঙ্গীয় বদ্বীপকে বিশ্বে আলাদা করে পরিচিত করেছে যুগে যুগে, বলতে বললে কোন চিন্তা না করেই বলে দেওয়া যাবে- সেই স্বাতন্ত্র্য হচ্ছে -পরম মমতায় আগলে রাখা অজস্র নদ-নদী এই জনপদের সবচেয়ে বড় স্বাতন্ত্র্য। নদীবিধৌত এই জনপদের জনজীবনের যে আখ্যান রচিত হয়েছে কালজয়ী সব সাহিত্যে, তাকে অনন্য না বলবার কোন উপায় আছে? এই অঞ্চলের মানুষের ক্রমবিকাশ যে নদ-নদীর ওপর কতোটা আবর্তিত হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
গণমানুষের জীবন ও জীবিকার সহায় হওয়া নদী যে কেবল বিচিত্র মৎস্য সম্পদ আর বয়ে আনা পলিতে উর্বর কৃষি ভূমিই দান করে চলেছে তাই নয়; গোটা অঞ্চলকেই চমৎকার যোগাযোগের সুঁতোয় বেঁধেছে এই নদীই। পরধনলোভী শাসকদের জন্যও বাধা হয়েছে এ নদী। নদীকে নিয়ে যে মহাকাব্য-তা হয়তো অতীতের মতো আগামীও রচনা করেই চলবে।
বুধবার সকালে ফের এক ঐতিহাসিক নৌযাত্রা শুরু হলো ঢাকার অদূরে পাগলা জেটি থেকে। বুড়িগঙ্গায় সূচনা করে শীতলক্ষা, মেঘনা-কীর্তনখোলা হয়ে খুলনা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে কার্ণিভাল ক্রুজের নৌযান ‘রাজারহাট সি’ যাত্রা করেছে কলকাতার পথে। সাত দশক পূর্বে এই নৌরুটে যাত্রাবাহী নৌযান চলাচল করতো নিয়মিতই। অখণ্ড স্বদেশে নৌ যাতায়াতের সেই গল্প উৎকীর্ণ আছে বহু সাহিত্য আর জীবনালেখ্যে। কিন্তু সে সবই আজ অতীত। খণ্ডিত স্বদেশে অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির পূর্ব আর পশ্চিমের ঐতিহাসিক নৌরুট থমকে ছিল বহুদিন। বন্ধুপ্রতীম বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারের সদিচ্ছায় হওয়া চুক্তি সত্ত্বেও নানা জটিলতায় আটকে ছিল যাত্রী পরিবহণ। বাধা কাটিয়ে আশার আলো হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কার্ণিভাল ক্রুজ চালু করল নৌযান রাজারহাট সি।
মূলতঃ নদীপিপাসু পরিব্রাজক ও কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে যাত্রা করা এই নৌযান বুধবার রওনা হয়ে শুক্রবার দুপুরে পৌঁছাচ্ছে কলকাতায়। বহুল প্রতীক্ষিত এই যাত্রায় নদীর পথে পথে যে তীরবর্তী অধিবাসীদের জীবন ও প্রকৃতির যে রূপ ধরা দিয়েছে তাতে শহুরে বাসিন্দা অভিযাত্রীরা মুগ্ধতার সঙ্গে কেবল একটি কথাই উচ্চারণ করছেন, ‘একই তো দেশ, দেখতে একই রকম’।
যাত্রা পথে সুন্দরবনের দুই দেশের অংশ পেরুতেই দীর্ঘ সময় লেগে যায়। যাত্রীদের বিস্ময় বাড়ে, এতো বড় বন হয়! শহুরে বাসিন্দাদের এই ধারণাই নেই যে কত বিপুল জলরাশি অনাদিকাল থেকে নিরবে বয়ে চলছে। নদ-নদীকে ক্রমাগত ‘হত্যা’ করে চলা আমরা হয়তো ভারতেই পারি না, তবুও এতো বিস্তৃত নৌপথ আছে আমাদের!
প্রায় আড়াই দিনের একমুখি যাত্রায় যাত্রীরা জেলেদের মৎস্য শিকার দেখেছেন, দেখেছেন সূর্যোদয়, দেখেছেন শুশুকের হঠাৎ জেগে উঠা। মাঝপথে নদীর পোয়া মাছ সংগ্রহ করে রাতের নৈশভোজের স্বাদ নিয়ে ফের নদীর মাছ সংগ্রহে ব্যাকুলতা, কিংবা নাব্যতা সংকটে কোথাও নৌযান আটকে যাওয়া-এমন নানা ঘটনায়, গল্পে-আড্ডায় নদীর হিমেল আলিঙ্গনে এই নৌযাত্রা যে সকল আরোহীর মনে চিরকালের মতো দাগ কেটে থাকবে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। সেই সঙ্গে আপ্লুত আরোহীদের কণ্ঠে শুধুই শোনা গেছে, সার্ভিসটি আবার বন্ধ হয়ে যাবে না তো?