শববাহী গাড়িটির ভেতরে স্ট্রেচারে শোয়ানো সাদা কাপাড়ে মোড়ানো এক তরুণীর দেহ। সেই নিরব-নিথর-নিস্তব্দ দেহ জড়িয়ে আছেন এক তরুণ। কখনো দেহটিকে বুকে আগলে রাখছেন, কখনো আবার কপালে এঁকে দিচ্ছেন স্নেহের চুম্বন। তরুণের মুখে ক্লান্তি, বিষণ্ণতার ছাপ। একটু পর পর ওই তরুণীর শরীর ভিজে যাচ্ছিল তরুণের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলে। আবহে বাজছে সেই মন খারাপের সুর, ‘এত রঙিন, এত কাপড়, কিছুই ভালো লাগে না মোর! সাদা কাপড় আমায় পরাই দে, সজনী তোরা..সাজিয়ে গুঁজিয়ে, দে মোরে…!’
অন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়া ১৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিওর দৃশ্য এটি। চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়া ওই তরুণীর নাম পিউলি নন্দী। হাসপাতাল থেকে তার মরদেহবাহী গাড়িতে তোলা হয়েছে, একটু পরেই শেষবারের মতো ফিরে যাবেন বাড়িতে। গাড়িটির দু’পাশে সব বয়সের মানুষ দাঁড়িয়ে। অঝোরে কাঁদছেন অনেকেই। তখন ওই তরুণীর স্বামী অনিমেষ চৌধুরী গাড়িতে ওঠে জড়িয়ে ধরেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে।
মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) ছিল অনিমেষ-পিউলি দম্পত্তির বিয়ের দশমাস-পূর্তি। দিনটি ঘিরে ছোটখাটো উৎসবের আয়োজনও ছিল দুজনার। কিন্তু সেই আনন্দোৎসব কিনা ভেসে গেল শোকের-সাগরে। স্বামীকে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীতে থাকতেন পিউলি। কয়েকদিন আগে বেড়াতে যান বাবার বাড়ি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে। সেখানে মঙ্গলবার দুপুরে গোসল শেষে বাড়ির উঠানে টানানো তারে কাপড় শুকাতে গেলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন তিনি। পরে স্বজনেরা ছুটে এসে দ্রুত পিউলিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যান। কিন্তু শত প্রচেষ্টায়ও বাঁচানো যায়নি ২৫ বছরের তরুণীকে। মৃত্যুর সময় পিউলি ছিলেন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মায়ের আকস্মিক মৃত্যু কেড়ে নিল পৃথিবীর মুখ না দেখা সন্তানের প্রাণও।
পিউলি আর অনিমেষ যেন ছিলেন একই বৃন্তে দুটি কুসুম! কয়েকবছর জমিয়ে প্রেম। তারপর সাতপাকে বাঁধা। দিনটি ছিল গত বছরের ১০ নভেম্বর। দুজনের ভরপুর ভালোবাসা একটু একটু করে আরও ডালপালা মেলছিল। অপেক্ষায় ছিলেন নতুন অতিথি আসার। অনাগত সন্তানকে ঘিরে দুজনের কত-শত পরিকল্পনা। সেই স্বপ্ন অনিমেষের জীবনে যে দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসবে কে জানত! পরিস্থিতি তার জীবন থেকে শুধু পিউলিকে কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে মায়ের সঙ্গে দূর আকাশের তারা হয়ে যাওয়া সন্তানকেও।
পিউলির ফেসবুক ঘাঁটলেই দেখা মিলে অজস্র হাসিমুখের ছবি। সেই চির হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটি এভাবে কাঁদিয়ে বিদায় নেবে মানতে পারছেন না কেউই। অনেকে আবার অনিমেষের মনের অবস্থা কেমন চলছে-তাও বোঝার চেষ্টা করছেন তার এই দুর্দিনে।
জনি দত্ত নামের এক তরুণ পিউলি-অনিমেষের শেষ ভালোবাসার ১৯ সেকেন্ডের ভিডিওটি শেয়ার করেছেন নিজের ফেসবুকে। সেই ভিডিওটি মুহূর্তে নেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। দুদিনে ৯ লাখ ৪৬ হাজার মানুষ দেখে ফেলেছেন ভিডিওটি।
সেই ভিডিও শেয়ার করে রাজিব কুমার সাহা নামের অনিমেষের পরিচিত এক তরুণ লিখেছেন, ‘কতো সুন্দর করে লাইফটা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলো। বিদ্যুৎস্পৃষ্টে পুরো জীবনটাই কেড়ে নিলো। এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাবে কল্পনাও করতে পারছি না। বিয়ে হয়েছে বেশিদিন হয়নি। ভগবান এটা কি করলেন, এই ছেলেটা কাকে নিয়ে বাঁচবে? ৭-৮ বছরের প্রেম অতঃপর বিয়ে। আসলে কি সান্ত্বনা দেব বুঝতে পারছি না। ভিডিওটি দেখে নিজের মনকে বোঝাতে পারছি না। এইটুকুই বলবো অনিমেষ নিজেকে শক্ত করো, জানি এটা শক্ত হবার মতো নয়।’
মিঠু দাশ নামের অনিমেষ-পিউলির পরিচিত তরুণের লেখায়ও উঠে আসে দুজনের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। মিঠু লেখেন, ‘বিবাহিত জীবনের আজ ১০ মাস পূর্ণ হলো তোমাদের, আর আজই চলে যেতে হলো? ভগবানের কি লীলাখেলা এতো তাড়াতাড়ি কেন তোমাকে নিয়ে গেল জানি না! যেখানে থেকো ভালো থেকো আমার বোন পিউ।’
অল্প কদিনে শ্বশুরবাড়িরও প্রিয়মুখ হয়ে ওঠেছিলেন পিউলি। কিশোর নন্দী নামের আরেক জনের স্মৃতিচারণে ওঠে এলো সেটি, 'অল্পদিনের সংসারে তুই শ্বশুর বাড়ির এত এত প্রিয় হয়ে গিয়েছিলি আজ জানিয়ে দিতে হলো এভাবে! আর অল্প কটা দিন গেলেই তো মাতৃত্বের অমর অনুভূতি পাওয়া হতো, ছোট্ট সুন্দর জীবনটাকে এত ছোট করে চলে গেলি না ফেরার দেশে বোন আমার।'
আর কদিন পরেই দুর্গাপূজার মৌসুম। সেই পূজা ঘিরে সনাতন ধর্মের মানুষদের ঘরে ঘরে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে আলোর উৎসব। সেই রঙিন আয়োজনের আগেই বিবর্ণ হয়ে ওঠল অনিমেষের জীবন, তিনি যে হারিয়ে ফেললেন নিজের জীবনের কাছের মানুষকে। স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়েছেন অনিমেষ। তাই তার সঙ্গে হলো না কথা।
নিজের আসন্ন মৃত্যু কি জেনেই গিয়েছিলেন পিউলি! না হয় মৃত্যুর দুদিন আগেই কেন বা নিজের ফেসবুকে তিনি শেয়ার করবেন-‘একদিন শ্মশানে হবে পোড়া ছাই ও মন আমার, গৌরব করার কিছুই নাই’ গানটি।
পিউলির জীবনে খুব দ্রুতই গানের কথাগুলো যে সত্যি হয়ে গেল। খুব নির্মভাবে সত্যি হয়ে গেল!
পিউলির এভাবে হাসতে হাসতে চলে যেতে দেখে তাই তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের 'কবি' উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো বলতে ইচ্ছে হয়, 'জীবন এত ছোট কেনে...'