বাংলা শুধু বাঙালির ভাষাই নয়, বহু বিদেশিরও প্রিয় ভাষা। ভালোবাসার টানে কিংবা কাজের প্রয়োজনে বাংলা ভাষায় বলা, পড়া, লেখা শিখেছেন বহুজন। জনপ্রিয় গানে যেমন আছে, ঠিক তেমনি: ‘আমি বাংলায় কথা কই/আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই।’
বাংলা-প্রেমিকদের কয়েকজনের কথা ভাষার ফেব্রুয়ারি মাসে আলোচনা করা যেতে পারে। তাদের একজন উইলিয়াম রাদিচে। তার সঙ্গ ব্যক্তিগভাবে একাধিক বার পেয়েছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান, যিনি নজরুল ইন্সটিটিউটের পরিচালক ছিলেন, রাদিচে তাঁর কাছে প্রায়ই আসতেন। বিলাতের এই পণ্ডিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর মুখে এতো চমৎকার ও পরিশীলিত বাংলা শুনেছি যে, বক্তার মুখ না দেখতে বোঝার উপায় ছিল না তিনি বিদেশি। শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্যের একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত তিনি। বিলাতের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ান।
বিশেষজ্ঞ ও অনুবাদক ড. মার্টিন কেম্পশেন কথাও প্রসঙ্গত বলা যায়। বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এই বিদেশি। তিনি জার্মানিতে বাংলা চর্চার চালচিত্র তুলে ধরেছেন নিজের নিটোল ও শুদ্ধতম বাংলা রচনায়। অনেক স্থানেই বক্তৃতা ও আলোচনাতেও সেসব কথা সবিস্তারে বলেছেন। তার বাংলা যে একজন বিদেশির, সেটা মনেই হয় না। বাংলাকে তিনি এমনই গভীরভাবেই আত্মস্থ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জার্মানির নিবিড় যোগাযোগের কথা কারো অজানা নয়। বিশ্বভ্রামণিক রবী ঠাকুর মোট তিন বার জার্মানি সফর করেছিলেন৷ আলব্যার্ট আইনস্টাইনের মতো জার্মানির অনেক সমসাময়িক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। জার্মান লেখক গোয়েটে ও হাইনের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে সবিশেষ পরিচিত ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি ও কর্মের নানা বিষয়ে সে দেশে নিয়মিতই মূল্যায়ন-আলোচনা করা হচ্ছে। এই কাজের শরিক শান্তিনিকেতনবাসী জার্মান অনুবাদক, লেখক ও সমাজকর্মী মার্টিন কেম্পশেন, যিনি বাংলাদেশের বোদ্ধা মহলেও অপরিচিত জন নন।
বেশ ক বছর আগে ঢাকা ঘুরে গিয়েছিলেন সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা শ্মশ্রুমন্ডিত এক বিদেশি সাহেব। কিন্তু তিনি কথা বলছিলেন দিব্যি বাংলায়। হ্যাঁ, একটু কৌতুকের সঙ্গে তিনি নিজেকে ‘সাহেব’ও বলতেন মাঝে মধ্যে। সাধারণ পোশাক-আশাক এবং চলন-বলনে তাকে কিন্তু এক সৌম্যকান্ত বাঙালি বৃদ্ধের মতোই মনে হত। আসলে তিনি একজন বিদেশি মিশনারি– নাম ফাদার দ্যতিয়েন। মা-বাবা নাম রেখেছিলেন পল দ্যতিয়েন। পল দ্যতিয়েন জন্মেছিলেন বেলজিয়ামের রশ্ফয় নামের একটি জায়গায় ১৯২৪-এর ৩০ ডিসেম্বর। বাবার নাম ফ্যানি এবং মা এলিজাবেথ।
বাংলাভাষী অঞ্চলের বিদ্ব্যৎ সমাজে ফাদার দ্যতিয়েন এক সুপরিচিত ও শ্রদ্ধেয় নাম। তার মাতৃভাষা ফরাসি হলেও বাংলা ভাষায় তার ব্যুৎপত্তি রীতিমত ঈর্ষণীয়। বাংলা ছাপাখানা, পত্রিকা ও বইয়ের জনক উইলিয়াম কেরীর পুত্র ফেলিক্স কেরী বহু বছর আগে বলেছিলেন, ‘বাংলা তার দ্বিতীয় মাতৃভাষা।’ কয়েক শত বছর পরে বিদেশিদের মধ্যে একথাটি খুব জোরের সাথে বলতে পারতেন ফাদার দ্যতিয়েনও। ১৯৭১-এ পুস্তকাকারে প্রকাশিত তার বাংলা রচনা ডায়েরির ছেঁড়া পাতা এবং ১৯৭৩-এ প্রকাশিত রোজনামচা তাকে বাংলা ভাষার এক শক্তিমান লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এমন উদাহরণ একটি নয়, একাধিক। ঢাকায় ভাষা ইনসটিটিউটে অনেক চাইনিজ ও কোরিয়ানের দেখা পাওয়া যায়, যারা চমৎকার বাংলা বলেন। ভারতের এমন অনেক গায়ক ও শিল্পী আছেন, যারা বাংলাভাষী না হয়েও অপূর্বভাবে গান গেয়েছেন। কে বলবে, তালাত মাহমুদ বাঙালি নন। অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে এমন উদাহরণ বহু। বলে না দিলে সাধারণত কেউই বুঝতেও পারবে না যে, এইসব গায়ক ও অভিনেতা-অভিনেত্রী-শিল্পী বাংলাভাষী নন।
খোঁজ নিলেই দেখা যাচ্ছে, ভালোবেসে বাংলাকে মুখে বা কলমে তুলে নেওয়া বিদেশির উজ্জ্বল চেহারা। বলাই বাহুল্য যে, বাংলা শেখা বা লেখা বাণিজ্যিক অর্থে বা চাকরি-বাকরির দিক থেকে লাভজনকও নয়। তারপরেও ফরাসির পরেই বিশ্বের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ভাষা বাংলা শেখার জন্য অনেকেই আগ্রহী হন। কেউ কেউ আর্দশ-স্থানীয় মানেও উত্তীর্ণ করেন নিজেদের বাংলা ভাষার জ্ঞান ও দক্ষতাকে। এর ফলে বিদেশে যেমন বাংলা ভাষার প্রসার হচ্ছে, বিদেশিদের হাত ধরে বাংলা ভাষাও অপরাপর ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে নানা কিছু আহরণের সুযোগ পাচ্ছে। বাংলা বৈশ্বিক ভাষার সঙ্গে গতিশীল লেনদেনে প্রভূত সমৃদ্ধ হচ্ছে।
আরও একটি বিষয় এতে প্রমাণিত হয়। তাহলো, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা বিশ্বের বহু মানুষের কাছেই আগ্রহের বিষয়। কোনও ধরনের আর্থিক বা বৈষয়িক লাভালাভের বাইরে কেবল মাত্র ভাষাগত আকর্ষণে বাংলা শিখতে ছুটে আসার বিষয়টিও কম শ্লাঘার নয়! তারপরেও আমরা নিজেরা যদি মায়ের ভাষা বাংলায় গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে না পারি, তা হলে কেমন দেখায়!
বিখ্যাত গানের ‘আমি বাংলায় কথা কই/আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই’ কথাগুলো শুধুমাত্র আবেগ ও উচ্ছ্বাস দিয়ে বিশেষ বিশেষ দিনে গাইবার বিষয় নয়, জীবনের সর্বক্ষণ, প্রতিদিনই আত্মস্থ ও চর্চা করারও বিষয়।