নাগরিক রসনায় শীতের আমেজ

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পাহাড়তরী ওয়্যারলেস মোড়ে পিঠার দোকান, ছবি: বার্তা২৪.কম

পাহাড়তরী ওয়্যারলেস মোড়ে পিঠার দোকান, ছবি: বার্তা২৪.কম

ধীর পায়ে আসছে শীত। শোনা যাচ্ছে শিশিরের পদধ্বনি। এদিকে, দূষণ ও যান্ত্রিক তাণ্ডবে রাজধানী ঢাকা হয়ে আছে উতপ্ত। তবে, ছোট শহর আর গ্রামের দিকে কুয়াশার প্রলেপ মেখে হাজির শীতের আগাম পরশ।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের পরিবেশগত বৈচিত্র্যের কারণে উত্তরবঙ্গে, সিলেটে, চট্টগ্রামে শীত চলে আসে আগেভাগে। ফলে আবহাওয়ার নির্দেশ মেনে তীব্র শীত আসার আগেই নাগরিক রসনায় যুক্ত হয়েছে শীতের আমেজ। পোশাকেও আসছে পরিবর্তন। বাহারি রঙের গলাবন্ধ, ফুলহাতা জামা-কাপড় আলমারির বন্দিজীবন থেকে বের হয়ে মানুষের শরীরে ঝলমল করছে।

খাবার-দাবার নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনও শেষ নেই। মৌসুম ও পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিটি সমাজেই বেছে নেওয়া হয় উপযুক্ত খাবার-দাবার। যে কারণে শীত-প্রধান আর গ্রীষ্ম-প্রধান অঞ্চলের খাদ্য তালিকা সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলাদেশেও ঋতুতে ঋতুতে বদলায় খাদ্যাভ্যাস, রুচি ও খাবারের মেনু।

বিজ্ঞাপন

চিরায়ত বাংলার গ্রামে-গঞ্জে শীতের আবহে পাওয়া যায় খেজুরের রস, পিঠা, পুলি। বাংলার শীত মানেই বিচিত্র খাবারের সম্ভার। গ্রামের খাদ্য তালিকা শহরের ব্যস্ততা ও ভিড়ে পাওয়া সহজ নয়। শহরের বাস্তবতায় চট-জলদি খাবারের দস্তুরই বেশি। ফাস্ট ফুড, ইনস্ট্যান্ড কফি, চটপটি এন্তার পাওয়া যায় শহরের গলি, মোড় ও এভিনিউ-এ।

তবে, ইদানিং শহরেও পাওয়া যাচ্ছে শীতের পিঠা, পুলি। প্রসার বাড়ছে চিরায়ত খাবারের আইটেমগুলোর। খালা ও নানী বয়সী মহিলারা নানা জাতের পিঠা সরাসরি তৈরি করছেন জ্বলন্ত উনুনে। নানা বয়সের মানুষ ভিড় করে খাচ্ছেন সেসব। এভাবেই শাশ্বত বাংলার ঐতিহ্য ফিরে আসছে নগরের বিন্যাসে। মানুষ উপভোগ করতে পারছেন শীত ঋতুর খাদ্য সম্ভার।

শহর ভেদে ও এলাকার পার্থক্যে খাবারের পরিবর্তন বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। দেশের বিভিন্ন শহরের খাদ্য-বৈচিত্র্যের মতোই বন্দর নগরী চট্টগ্রামের একেক এলাকায় দেখা পাওয়া যায় একেক রকমের খাদ্য তালিকা। চট্টগ্রাম শহরের এক প্রান্তে বৃহত্তর পাহাড়তলী এলাকাকে বলা যায় ‘রেল শহর‘। রেলের বহু কারখানা ও প্রতিষ্ঠান এখানে অবস্থিত। এক সময় রেলের কাজে যুক্ত হয়েছিল বিহারি লোকজন। তাদের অনেকেই এখনও রয়েছেন পাহাড়তলীর ওয়্যারলেস, ঝাউতলা, আম বাগান, সর্দার বাহাদুর কলোনি, পাঞ্জাবি লাইন, আকবর শাহ প্রভৃতি মহল্লায়। এখানেও চলে এসেছে শীতের পিঠা। তবে, সেগুলো চিরায়ত বাংলার মাটির উনুনে সরাসরি বানানোর বদলে তৈরি হচ্ছে আলাদা ভাবে। বলা ভালো, বাঙালি ও বিহার-উত্তর ভারতের উর্দু ভাষী সংস্কৃতির মিশেল হয়েছে এসব খাবারে।

পাহাড়তলী ওয়্যারলেস মোড়ে কায়দা করে সাজানো অনেকগুলো পিঠার দোকানের পাশাপাশি রয়েছে চাট হাউস। যেখানে মৌ মৌ করছে কাবাব, হালিম, তেহারি, নলা, বট, তন্দুরের সুগন্ধ। ঢাকায় যেমন মোহাম্মদপুর ও মীরপুরে বিহারি কলোনিগুলোর আশেপাশে পাওয়া যায় মাংসের অনেক রকম সুস্বাদু আইটেম, চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর কয়েকটি পয়েন্টেও মিলছে সেসব খাবার। আশেপাশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কর্পোরেট হাউসের তরুণ জনশক্তি ভিড় করছেন এসব দোকানে।

চাট হাউসে তরুণ প্রজন্মের ভিড়, ছবি: বার্তা২৪.কম

‘বেশির ভাগ সময় কফি শপে বসা হলেও মাঝেমাঝে স্বাদ বদল করতে এসব দোকানেও আসি', বললেন আইরিন শম্পা। তিনি বন্ধুদের নিয়ে খেতে খেতে বললেন, `খোলামেলা পরিবেশে মাংসের আইটেম বা পিঠা টেস্টে চেঞ্জের জন্য বেশ ভালো। শীতের আমেজে এসব ঝাল খাবার এক ধরনের উষ্ণতা দেয়।‘

খাদ্য বা খাদ্যাভ্যাস নিয়ে মানুষের আগ্রহ ঐতিহাসিক। খাবার বিষয়ক আলাপ-আলোচনা, ব্লক, পটকাস্ট বর্তমানে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তার একটি কারণ হয়তো মানুষের যাপনের ইতিহাসের সঙ্গে এর ওতপ্রোতভাবে সম্পর্ক। ক্যারল ক্যুনিহান, কেন আলবালা, কৃষ্ণেন্দু রায়, লিজ়ি কলিংহ্যাম, তপন রায়চৌধুরী তাবড় পণ্ডিতেরা লিখেছেন, খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস কীভাবে সমাজচিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। খাদ্য যে শুধু রসাস্বাদনের কথা বলে তা তো নয়, বৈচিত্র্য ও বৈষম্যের কথাও বলে। সংস্কৃতি তথা বর্ণ, লিঙ্গ, জাতপাতের ভেদাভেদের কথাও বলে।

খাবার বিষয়ক বইও বেশ পাঠকপ্রিয়তা পাচ্ছে আজকাল। মুঘল খাবারের নানা ধরন নিয়ে রয়েছে একাধিক বেস্ট সেলার বই। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ঘরানার খাদ্য, যেমন হায়দরাবাদী, দক্ষিণ ভারতীয়, কাশ্মিরী সম্পর্কে এবং বিশেষত স্ট্রিটফুড নিয়ে বিস্তর লেখালেখি রয়েছে। অধুনা নীলাঞ্জন হাজরা ‘খিচুড়ি‘র আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন আস্ত একটি বই। আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, চাল-ডাল মিশ্রিত এই খাদ্যের চমৎকার উপস্থাপনা রয়েছে বইটিতে। লেখক জানিয়েছেন, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে আদি-মধ্যযুগে প্রচলিত নিরামিষ খিচুড়ির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার জন্য বানানো ‘রাইস আ লা স্যোর নাইটিঙ্গল’ সম্পর্কেও।

বাংলাদেশের শহরগুলোতে, বিভিন্ন অঞ্চলে, ঋতুতে ঋতুতে খাবারের যে বৈচিত্র্য, তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে কমই। সামাজিক বিজ্ঞানের পরিসরে খাদ্য সংস্কৃতি ও রুচির মধ্যকার সম্পর্ক পরিমাপ করাও একটি জরুরি কাজ বটে। নাগরিক রসনায় শীতের আমেজ মেখে মুখরোচক খাদ্য আস্বাদনের পাশাপাশি সেসবের উৎপত্তি, বিকাশ ও ইতিহাস জানাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক।