আজ মহান একুশে। হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত করেছে ১৯৫২ সালের অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতিসত্তার জাগৃতিতে অমর একুশে এক মহামন্ত্র।
সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস থেকে জানা যায় মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি, সে জাতি উন্নয়নের ধারায় তত বেশি অগ্রণী। নিজেদের ভাষাকে উন্নত ও কাযকরী করেই বিশ্বের জাতিসমূহ উন্নত ও অগ্রসর হতে পেরেছে। বাংলা ভাষাকে ধরেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথে বাঙালি পেয়েছে রাজনৈতিক চেতনা ও স্বাধীনতার মহাপথ। বাংলা ভাষার উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথ ধরেই জাতি পাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতীতি।
বাংলাদেশ এবং চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের উদাহরণ লক্ষ্য করলেই বক্তব্যটি স্পষ্ট হয়। সেসব দেশ নিজেদেরকে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে গেছে। তাদের ভাষাকে উন্নত করেছে। শিক্ষাকে প্রসারিত করেছে। সামগ্রিক উন্নয়ন এভাবেই সম্ভব হয়েছে প্রথমে ভাষা এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার হাত ধরে।
শিক্ষা ও উন্নয়নে মাতৃভাষা বাংলাকে যেভাবে মূল্যায়ন দরকার, তা আমাদের এখানে অনেক পিছিয়ে। ফলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। এর পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে অন্যদের সাথে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার ব্যবহার অব্যশই মাথায় রাখতে হবে। যেহেতু সারা বিশ্বে ইংরেজি ভাষার প্রচলনই সব থেকে বেশি এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে তারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে সেহেতু একটি ভালো চাকরি, কর্মসংস্থান যাই বলি না কেন তা অনেকাংশে নির্ভর করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার ওপর। কিন্তু মাতৃভাষায় দুর্বল থেকে বিদেশি ভাষায় সবলতার আশা করা দুরাশার নামান্তর।
বরং মাতৃভাষাকে কেন্দ্রে রেখে বিভিন্ন ভাষার একটি আবহ তৈরি করাই কাম্য। যার মাধ্যমে বিশ্বের নানা দেশের জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য গ্রহণ করা এবং সেসবকে নিজের দেশ ও সমাজে প্রয়োগ করাও সহজতর হবে। সম্ভব হবে বৈশ্বিক জ্ঞানকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া। এইক্ষেত্রে অবশ্যই মাতৃভাষাকে সামনে রাখতে হবে। কেননা, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে যখন কোনো জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বিসর্জন দেয় তখন তারা তাদের নিজস্ব জাতিসত্তা হারিয়ে ফেলে। নতুন কিছু শিখতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার চেয়ে বিপদ আর কিছুতেই হতে পারে না।
ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজি শিখিয়ে একদল মানুষকে ইংরেজ-দাসে পরিণত করা হয়। এরা জাতিতে এদেশিয় হলেও আচরণ ও মনোভাবে ছিলেন ইংরেজ গোলাম। সেসব হয়েছিল উপনিবেশিকতার আগ্রাসনে। স্বাধীন দেশে এমন আগ্রাসন চালানোর কেউ নেই। এখন জাতিসত্তার বিশুদ্ধতার যাবতীয় শর্ত অক্ষূণ্ন রেখেই বিভিন্ন ভাষা ও জ্ঞান আহরণ সম্ভব। কাজটি স্বকীয়তা, নিজস্বতা ও আত্মপরিচিতি সংরক্ষণ করেই করতে হবে। একদিকে ইংলিশ মিডিয়ামে সাহেব আর অন্যদিকে মাদ্রাসায় হুজুর বানানোর মতো বৈপরীত্য দিয়ে নয়, বরং সবাইকে বাঙালিত্বের চেতনায় সমন্বিত করেই তা করা দরকার। কারণ, বাংলা যেহেতু আমাদের মায়ের ভাষা তাই শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষায় এ ভাষার ব্যবহার থাকলেই মানুষ নিজেকে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে, পারিপার্শ্ব এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলকে সঠিক ও ভালোভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে।
দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, বাংলাদেশের সংবিধানে ৩নং অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলার কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ না আছে উচ্চশিক্ষায় না উচ্চআদালতে। ফলে বর্তমান প্রজন্ম, মুখস্থবিদ্যার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। বাংলাকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার পিছিয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাষা বৈষম্য তৈরি করছে। যে বৈষম্য ক্রমেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও পার্থক্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রয়োগ বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বছরের পর বছর নানা রকমের পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: জাতীয় শিক্ষানীতিতে বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারে বাধ্যতামূলককরণ; বাংলা শব্দভাণ্ডার উন্নত করা; উচ্চ শিক্ষায় প্রয়োজনীয় গ্রন্থগুলোর বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা গ্রহণ; বাংলা ভাষার জন্য গবেষণাকেন্দ্রের সক্রিয় ভূমিকা ও কার্যক্রম; বাংলা ভাষার শৈল্পিক, ব্যাকরণিক এবং লিখিত রূপের সহজবোধ্যতা আনয়ন; বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রবাসী বাংলা ভাষী ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপন; সর্বস্তরে নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য বাংলা ভাষার প্রচলন; বাংলা ভাষার গুরুত্ব বোঝাতে সবার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ; বাংলা সংস্করণে বেশি বেশি কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি করা এবং বাংলা ভাষাকে দ্রুত প্রযুক্তি-বান্ধক করতে উদ্যোগী হওয়া।
ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরিয়ে এসেও সর্বক্ষেত্রে-সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার সম্মানজনক প্রতিষ্ঠা করতে না পারাটা সত্যিই বেদনার। একুশের মহান লগ্নে সেই বেদনাকে আশাবাদে পরিণত করার শপথ উচ্চারিত হওয়ায় প্রত্যাশিত।