‘দুর্ঘটনাপ্রসূত’ আবিষ্কার এন্টিবায়োটিকের ইতিহাস

, ফিচার

সাইফুল মিল্টন, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 22:03:59

“আমি পেনিসিলিন উদ্ভাবন করিনি বরং প্রকৃতিই তা করেছে। এটা আমার দুর্ঘটনাপ্রসূত আবিষ্কার মাত্র”—পৃথিবীর প্রথম এন্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কার সম্বন্ধে এটা ছিল আবিষ্কারক বিজ্ঞানী অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের সরল স্বীকারোক্তি।

সাধারণভাবে এন্টিবায়োটিক বলতে বোঝায় বিভিন্ন অণুজীব থেকে প্রাপ্ত উপাদান যা মানবদেহে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করে বা এগুলোকে মেরে ফেলে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার এন্টিবায়োটিক আজ রোগ নির্মূলে বহুল ব্যবহৃত ঔষধ। বিজ্ঞানের অন্যান্য আবিষ্কারের মতো এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারেরও আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস।

এন্টিবায়োটিকের ইতিহাসকে আলোচনার সুবিধার্থে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি, প্রাচীন কালের ইতিহাস ও আধুনিক ইতিহাস। প্রাকৃতিক উপাদানের যে রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা আছে, তা এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের বহু পূর্বে মানুষের জানা ছিল। প্রাচীনকালে মানুষ ক্ষত নিরাময়ে বিভিন্ন জৈব পদার্থ ব্যবহার করত। যেমন—
➤ গ্রিক ও ভারতীয়রা ক্ষতস্থানের সংক্রমণ রোধে ছত্রাক ও অন্যান্য উদ্ভিদ ব্যবহার করত।
➤ রাশিয়ানরা আঘাতপ্রাপ্ত স্থানের ঘা শুকাতে ঈষৎ উষ্ণ মাটি ব্যবহার করত।
➤ সুমেরীয়ও সভ্যতার সময়ে চিকিৎসকরা কচ্ছপের খোল ও সাপের চামড়া প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহার করত।
➤ ব্যাবিলনীয়রা ব্যাঙের পিত্ত ও টক দই দিয়ে ওষুধ তৈরি করে চোখের সংক্রমণ রোধ করত।
➤ প্রাগৈতিহাসিক আমলে সিংহলী সৈন্যরা ক্ষত নিরাময়ে অয়েল কেক ব্যবহার করত।
➤ বহু বছর আগে চীনে সয়াবিনের ছত্রাক আক্রান্ত বীজ বিভিন্ন ফোঁড়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো।

এন্টিবায়োটিকের আবিষ্কারক স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ◢ 


আধুনিক এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারে অগ্রগামী ভূমিকা রাখার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (১৮৮১-১৯৫৫) নামটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন একাধারে চিকিৎসক, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, ফার্মাকোলজিস্ট ও অণুজীববিজ্ঞানী (ব্যাকটেরিয়োলজিস্ট)। ১৮৮১ সালে স্কটল্যান্ডের লোচফিল নামক ছোট্ট শহরতলীতে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফ্লেমিং। সেখানে স্কুল জীবনের পাঠ চুকিয়ে ১৮৯৫ সালে লন্ডনে বড় ভাই থমাস ফ্লেমিংয়ের বাসায় ওঠেন। ভর্তি হন লন্ডন রিজেন্ট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে যা বর্তমানে ওয়েব মিনিস্টার বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ফ্লেমিং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর স্কটিশ রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন। ১৯০১ সালে চাচার পরামর্শ ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে সেন্ট মেরি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে অসাধারণ ফলাফল করায় কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে সোনার মেডেল প্রদান করে। বিজ্ঞানী ফ্লেমিংয়ের ইচ্ছা ছিল সার্জন হবার কিন্তু ঘটনাচক্রে একই মেডিকেল কলেজের ইনকুলেশন ডিপার্টমেন্টে গবেষক হিসাবে যোগ দেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মানুষের মৃত্যুর মিছিল গভীর দাগ কাটে তরুণ গবেষক ফ্লেমিংয়ের মনে


১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আনুমানিক ৬০ মিলিয়ন ইউরোপীয় ও ৭০ মিলিয়ন সেনাসদস্য ইতিহাসের এই ভয়াবহতম সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং এসময়ে সেনাবাহিনীর রয়্যাল মেডিকেল কোরের সদস্য হিসাবে কর্মরত ছিলেন। নিজের চোখে দেখা মহাযুদ্ধে মানুষের মৃত্যুর মিছিল গভীর দাগ কাটে তরুণ গবেষক ফ্লেমিংয়ের মনে। চারিদিকে মৃত্যু আর মৃত্যু, মানুষ যেন মানুষের শত্রু। তার চেয়েও বড় শত্রু আহতদের মধ্যে ‘জীবাণু সংক্রমণ’ যা থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকরা অনেকটা অসহায় ছিল সেসময়। এটাই ফ্লেমিংকে এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের প্রাথমিক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।

১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফ্লেমিং সেন্ট মেরি হাসপাতালে ইনকুলেশন ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর পদে পুনর্যোগদান করে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। ১৯২৮ সালের এক স্নিগ্ধ বিকেলে ফ্লেমিং একমাসের অবকাশ যাপন শেষে যখন ল্যাবরেটরিতে ফিরে আসেন তখন এক আশ্চর্য জিনিস দেখেন। তিনি দেখেন তার একটি পরীক্ষা পাত্রে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া স্টেফাইলোকক্কাস এক প্রকার ছত্রাকের আবির্ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তিনি এই ছত্রাকের নাম দেন পেনিসিলিন। পেনিসিলিনের আবিষ্কার সেসময়ের দুরারোগ্য ব্যাকটেরিয়া বাহিত রোগসমূহ থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারবে বুঝেও এর উৎপাদনের স্বল্পতার কারণে বিজ্ঞানী মহল ফ্লেমিংয়ের আবিষ্কার নিয়ে পরবর্তী এক যুগ তেমন একটা গা করেনি।

এন্টিবায়োটিকের আবিষ্কার ও বাজারজাতকরণের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার পান এ তিন বিজ্ঞানী

১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরি (১৮৯৮-১৯৬৮) ও আর্নেস্ট চেইন (১৯০৬-১৯৭৯) এক পরীক্ষার মাধ্যমে পেনিসিলিন বিশুদ্ধকরণ ও ঘনীভবন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করে পেনিসিলিনের বাণিজ্যিক উৎপাদনের দ্বার উন্মুক্ত করেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৫ সালে এই দুই বিজ্ঞানীর সাথে পেনিসিলিনের আবিষ্কারক স্যার অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ফ্লোরি ও চেইনের গবেষণার কিছুদিনের মধ্যেই বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। এ মহাযুদ্ধে আহতদের জীবাণু সংক্রমণে মৃত্যু ঠেকাতে পেনিসিলিন বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই কল্যাণকর আবিষ্কারের ফলে অসংখ্য মানুষ প্রাণে বেঁচে ঘরে ফেরেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুল ব্যয়ের কারণে ব্রিটেনের জন্য এন্টিবায়োটিক গবেষণা ও উৎপাদনের খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় এন্টিবায়োটিকের উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমের বিশ্ববাসীকে এর সুফল দিতে এগিয়ে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উৎপাদনে ব্রিটিশদের ‘ফ্লাস্ক পদ্ধতির’ পরিবর্তে মার্কিনীরা কারখানায় স্থাপন করে ভারী যন্ত্রপাতি। এতে উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে যায়।

এন্টিবায়োটিক উৎপাদন কারখানায় ভারী যন্ত্রপাতি


এরপর এন্টিবায়োটিকের ইতিহাস শুধুই এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। আমেরিকার পাশাপাশি ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ভারত প্রভৃতি দেশে নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক গ্রুপ আবিষ্কৃত হয় যা সিফিলিস, গনেরিয়া, অ্যান্থ্রাক্স, গ্যাংগ্রিন, ডিপথেরিয়া, মেনিনজাইটিসসহ অনেক জীবাণুবাহিত রোগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে।

১৯৪৫ সালে নোবেল পুরস্কার হাতে নিয়ে স্যার অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, এন্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার প্রকৃতিতে এন্টিবায়োটিক সহনীয় (রেজিস্ট্যান্ট) ক্ষতিকারক অণুজীবের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে যা বুমেরাং হতে পারে। ফ্লেমিংয়ের এই সতর্কবার্তা বর্তমান এন্টিবায়োটিক পরিস্থিতিতে ধ্রুব সত্যে পরিণত হয়েছে। তাই তো আজ আমরা দেখি অনেক রোগীদের ওপর এন্টিবায়োটিক চিকিৎসা কোনো প্রভাব রাখতে পারে না। এন্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে প্রকৃতিতে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শরীরের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়াও এন্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহারে ধ্বংস হয়ে যায়, যার কারণে প্রকারান্তরে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।

সবশেষে এন্টিবায়োটিক নিয়ে একটা ঘটনা বলি। ভারতের হায়দ্রাবাদে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ওষুধ শিল্প এলাকা অবস্থিত। এখানে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নাকি প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণ এন্টিবায়োটিকের কাঁচামাল উৎপাদন করে। এই অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক উপাদান সংলগ্ন নদীতে গিয়ে মেশে। এতে হায়দ্রাবাদসহ অনেক দূর অঞ্চল পর্যন্ত এন্টিবায়োটিক সহনীয় জীবাণুর বিস্তার হয়। গবাদিপশু ও পানি বাহিত হয়ে এ জীবাণু অনেক মানুষকে আক্রান্ত করে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, নিজেদের তৈরি ওষুধের চাহিদা বাড়াতে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এরকম করে থাকে। অধিক মুনাফা লাভ করতে এরকম হীন কর্ম পৃথিবীর অনেক জায়গায়ই হয়ে থাকে।

আসুন, আমরা এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করে একে প্রকৃত অর্থে মানব কল্যাণে কাজে লাগাই। তা না হলে স্যার অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের অনন্য আবিষ্কার তার ভাষায় ‘দুর্ঘটনা প্রসূত’ই থেকে যাবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর