শহীদ জননী জাহানারা ইমাম শিশু-কিশোর উপযোগী রচনার কারণে ষাট ও সত্তর দশকে সাহিত্যজগতে কিছুটা পরিচিত পেয়ে থাকলেও পরে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধে তিনি পুত্র রুমী ও স্বামীকে হারান। স্বাধীনতার পর রুমীর বন্ধুরা মা জাহানারা ইমামকে সব মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করেন। রুমীর শহীদ হওয়ার সূত্র ধরেই তিনি ‘শহীদ জননী’র মযার্দায় ভূষিত হন। এছাড়া তিনি একাত্তরের ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলনের কাণ্ডারি ছিলেন। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়করূপেও তাঁর পরিচিতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মা সৈয়দা হামিদা বেগম। জাহানারা ইমামের শৈশবকালে মুসলিম পরিবারে মেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। বাবার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে তিনি আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। দাম্পত্য জীবনেও লেখাপড়ায় তিনি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা পেয়েছিলেন স্বামী শরীফ ইমামের কাছ থেকে।
বাবার চাকরিসূত্রে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ লাভ করেন। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। এখান থেকে বিএ পাস করেন ১৯৪৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯৬৫ সালে বাংলায় এমএ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে। ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন। এরপর ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৫২ থেকে ১৯৬০, বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হিসেবে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত তাঁর কর্মজীবন কাটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এ সময়টাতেই তিনি নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
গণমানুষের তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতা নিয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করে। এ সুযোগে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের নাগরিক ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী দলের আমীর ঘোষণা করা হলে দেশে গণবিক্ষোভের জন্ম হয়। এর ফলে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। এতে জাহানারা ইমাম নেতৃত্ব দেন। একসময় ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিরীহ মানুষকে হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ‘পাবলিক ট্রায়াল’-এর আয়োজন করেছিলেন। সেই একই আদলে বাংলাদেশে গোলাম আযমের জন্য ‘গণআদালত’ গঠন করে বিচারের আয়োজন করে জাতীয় সমন্বয় কমিটি। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। মূলত গণআদালত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ।
গণআদালত অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে সরকার ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করলে হাইকোর্ট তাদের জামিন মঞ্জুর করলেও জাহানারা ইমামের করেনি। লাখো জনতাসহ জাহানারা ইমাম ১৯৯২ সালের ১২ এপ্রিল গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবিতে তৎকালীন সরকার ও বিরোধী দলের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সারাদেশে গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করা হয়। এমনকি বিদেশেও গঠিত হয় নির্মূল কমিটি, হয় ব্যাপক আন্দোলনও। গোলাম আযমসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলনকে সমর্থন দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষণা করে আরো আটজন যুদ্ধাপরাধী—আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামরুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আব্দুল কাদের মোল্লার নাম ঘোষণা করা হয়।
পরের বছর স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান কবি বেগম সুফিয়া কামাল রাজপথের বিশাল জনসমাবেশে জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট হস্তান্তর করেন। মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জাহানারা ইমাম সর্বদা সক্রিয় ছিলেন। তিনি সংস্কৃতি অঙ্গনের হলেও দেশের স্বার্থের প্রয়োজনে তিনি রাজনীতির অঙ্গনেও নেমে আসেন।
একাত্তরের সেই দুঃসহ দিনগুলোর প্রাত্যহিক ঘটনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজের স্মৃতিঘিরে লিখেছিলেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’—যা ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: অন্য জীবন, বীরশ্রেষ্ঠ, জীবন মৃত্যু, চিরায়ত সাহিত্য, বুকের ভিতরে আগুন, নাটকের অবসান, দুই মেরু, নিঃসঙ্গ পাইন, নয় এ মধুর খেলা, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, প্রবাসের দিনলিপি প্রভৃতি।
বিভিন্ন সময়ে তিনি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। যেমন: বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮,) কমর মুশতরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), আজকের কাগজ থেকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কার (বাংলা ১৪০১ সন), নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা (১৯৯৪), স্বাধীনতা পদক (১৯৯৭), রোকেয়া পদক (১৯৯৮), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (২০০১), ইউনিভার্সাল শিল্পী গোষ্ঠী পুরস্কার (২০০১), শাপলা ইয়ুথ ফোর্স কারমাইকেল কলেজ গুণীজন সম্মাননা প্রভৃতি।
১৯৯৪ সালের ২৬ জুন আমেরিকার মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার জীবনাবসান হলেও ঢাকায় তাকে সমাহিত করা হয়।