অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর দশটা ছেলের মতো কেটেছে শৈশব কৈশোর, কলকাতায়। ঘিঞ্জি এলাকায় থাকতেন বলে ছোটবেলায় বস্তির ছেলেদের সাথে মার্বেল খেলতেন। তাঁর বাবা ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ইকোনমিক্সের অধ্যাপক। মাও একটা কলেজের একই বিষয়ের অধ্যাপক। ফলে তার জন্য যেন ইকোনমিক্স পড়াটা ছিল নির্ধারিত। সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়েছেন। পড়েছেন প্রেসিডেন্সিতে। পরে দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খেটেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৮৩ সালে তাঁকে আর তাঁর এক বন্ধুকে জেলে পাঠানো হয়েছিল খুনের চেষ্টার অভিযোগে।
২০১৬ সালে হিন্দুস্থান টাইমস-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে এমনই জানিয়েছিলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, “কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, অভিজিৎ ব্যানার্জির কথা মনে পড়ে? জেএনইউ ক্যাম্পাসকে দেশদ্রোহের আখড়া বানানোর অভিযোগে জেলে পাঠানো হয়েছিল তিন বাম ছাত্র নেতাকে। ১৯৮৩-তে আমাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের হয়েছিল।” এ তথ্য দিয়েছে গতকাল মঙ্গলবার জি নিউজ।
জি নিউজ জানায়, ওই সাক্ষাৎকারে নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, “ছাত্র আন্দোলন বামঘেঁষা ছিল বলে ওই পুলিশি কার্যকলাপকে পেছন থেকে সমর্থন করেছিল কেন্দ্রের কংগ্রেসি সরকার।”
তিনি ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, “ভর্তি প্রক্রিয়া বদলানোর দাবিতে আন্দোলন হচ্ছিল। ফি এতটাই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে তা সামলানো গ্রামীণ এলাকা থেকে পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্র সংসদ এর প্রতিবাদ করায় সংসদ সভাপতিকে বরখাস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখনই ছাত্র আন্দোলন আরো তীব্র হয়। সেই আন্দোলন দমন করতেই পুলিশ ঢোকে ক্যাম্পাসে। আমাদের মারতে মারতে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্দেহ নেই এতে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদত ছিল। পুলিশ বলেছিল, “আমরা বস। আমাদের কথার উপর কথা বলা যাবে না।” সাউথপয়েন্টের পর প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন অভিজিৎ। এরপর দিল্লির জেএনইউ। অভিজিতের মা নির্মলাদেবী মঙ্গলবার জি নিউজকে জানান, ছোটবেলায় বস্তির ছেলেদের সঙ্গে রাস্তায় খেলত অভিজিৎ। পরিবার আটকায়নি। সেই সময় থেকেই গরিবি, অভাব নিয়ে কৌতূহল ছিল। যত পথ এগিয়েছেন অভিজিৎ তত দারিদ্র নিরসনের সন্ধান পাওয়ার সন্ধানে এগিয়েছেন। তাই গ্রামীণ ছাত্রছাত্রীদের অতিরিক্ত ফি-র বোঝা তাঁকে হয়তো অমোঘ তাগিদেই আন্দোলনে সামিল করে দিয়েছিল। ৮৩-তে জেলে যাওয়া অর্থনীতির ছাত্র ৩৬ বছর পর নোবেল জিতলেন। বিয়ে করেছিলেন কলকাতার মেয়ে অরুন্ধতী ব্যানার্জিকে। তিনিও এমআইটির এখন প্রভাষক। তারা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় ডিভোর্স হয়। সেবছরই তাদের সন্তান কবির বন্দ্যোপধ্যায় মারা যায়। সেবছরই অভিজিৎ বিয়ে করেন এস্থার ডাফলোকে। তিনিও এবার একই বিষয়ে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
ফ্রান্সের মেয়ে এস্থার ডাফলো হতে চেয়েছিলেন ইতিহাসবিদ। কিন্তু অভিজিতের সঙ্গে প্রেমই যেন তাঁর গন্তব্য পাল্টে দিল। হয়ে উঠলেন অর্থনীতিবিদ। বিশ্বে দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে স্বামী অভিজিতের সঙ্গে নোবেল পেয়েছেন তিনিও। এস্থারই অর্থনীতিতে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেল প্রাপক। অর্থনীতিতে একই সঙ্গে একই বছর স্বামী-স্ত্রীর যুগ্মভাবে নোবেল প্রাপ্তি এই প্রথম। ১৯০৩ সালে পদার্থবিদ্যায় তেজস্ক্রিয়তার ওপর গবেষণায় স্বামী পিয়ের কুরির সঙ্গে নোবেল পেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী মেরি কুরি। মাইক্রো-ইকোনমিক্স নিয়েই মূলত গবেষণা এস্থারের। ১৯৭২ সালে প্যারিসে জন্ম। বাবা মাইকেল ডাফলো অংকের অধ্যাপক। মা ডাক্তার। ছোট থেকেই ইতিহাসের নানা বিষয় টানত এস্থারকে।
গতকাল মঙ্গলবার ফ্রান্সের দৈনিক ‘দ্য পিয়ারো’ ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রন্টিয়ারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “যখন বয়স আট বছর, চেয়েছিলাম ইতিহাসবিদ হতে। ইউনিভার্সিটিতে আমার বিষয়ও ছিল ইতিহাস। ১৯৯৩ সালে মস্কোতে দশ মাস থেকে অধ্যাপনা করি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস, রাজনীতি নিয়ে চর্চা শুরু করি। একই সঙ্গে আমার আকর্ষণের বিষয় হয়ে ওঠে অর্থনীতি। ইউনিভার্সিটি থেকে একই সঙ্গে ইতিহাস ও অর্থনীতি নিয়ে ডিগ্রি লাভ করি। কিন্তু অর্থনীতিবিদ হব এটি ভাবিনি কখনো। ১৯৯৯ সালে ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা শেষ করি। রিসার্চ স্কলার থাকার সময়েই আমার পছন্দের অধ্যাপক ছিল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জোসুয়া অ্যাঙ্গরিস্ট। অভিজিতের তত্ত্বাবধানেই বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা শুরু করি। সে-ই আমাকে বলে যে, অর্থনীতিই সব কিছুর চালিকাশক্তি। সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির। তার একথা আমাকে অর্থনীতিবিদ হতে উদ্বুদ্ধ করে। এর কয়েক বছর পরই অভিজিতের তাঁর ভারতীয় স্ত্রী অরুন্ধতীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়। সে তখন কাজে একটু অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। সেসময় এমআইটিতেই অধ্যাপক হিসেবে আমিও যোগ দিই। আগে ছিলাম ছাত্রী পরে সহকর্মী। সেসময়টায় আমি অভিজিৎকে অনেক সঙ্গ দিয়েছি। আমরা গবেষণার কাজে স্লাম এলাকাতে যেতাম। সেসময়ই আমাদের মধ্যে প্রেম হয়। ২০০৩ সালে এমআইটিতেই ‘পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’ তৈরি করি। অভিজিতের সঙ্গে এই ল্যাবেই অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে অন্তত ২০০টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। পেশা এবং গবেষণা ছাপিয়ে সম্পর্কের গভীরতা আরো গাঢ় হয়। একসঙ্গে জীবনের পথে চলার সিদ্ধান্ত নিই দুজনে। ২০১০ সালে জন্য ‘জন বেটস ক্লার্ক মেডেল’ পাই। ওই বছরেই ইউনিভার্সিটি অব ক্যাথলিক দে লাওভেন থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে যাই। সমাজ বিজ্ঞান এবং অর্থনীতিতে ইনফোসিস পুরস্কার পাই ২০১৪ সালে। জীবনের যে কোনো পর্যায়েই শক্ত খুঁটির মতো পাশে ছিল স্বামী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।”
২০০৮ সালে বিশ্বের ১০০ জন মেধাবী মানুষের মধ্যে সামনের সারিতেই এস্থার ডাফলোর নাম লেখে আমেরিকার ম্যাগাজিন ‘ফরেন পলিসি’। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর তালিকায় বিশ্বের সেরা আট অর্থনীতিবিদের মধ্যে নাম ওঠে এস্থারের। ২০১১ সালে ‘টাইম ম্যাগাজিন’-এর প্রকাশিত বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকাতেও প্রথম সারিতেই দেখা যায় এস্থার ডাফলোর নাম। এস্থার-অভিজিতের লেখা ‘Poor Economics: A Radical Rethinking of the Way to Fight Global Poverty’ প্রকাশিত হতে চলেছে চলতি বছরের নভেম্বরে। তাই আগামী মাসেই তারা ভারত আসবেন।
নোবেল কমিটির ঘোষণার পরে এস্থার ডাফলো ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় একই সঙ্গে বলেন, “বিশ্বে ৭০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। পাঁচ বছর বয়সের গণ্ডি পেরোবার আগেই ফি বছর মৃত্যু হয় ৫০ লক্ষ শিশুর। যার অন্যতম কারণ অপুষ্টি, স্বাস্থ্যহানি, এমন রোগ যা চিকিৎসার মাধ্যমে সারানো সম্ভব অথচ অর্থ এবং সচেতনতার অভাবে সেটা সম্ভব হয় না। আমরা সেসব মানুষের পাশে দাড়াতে চাই।”
আরো পড়ুন ➥ অ্যাবি আহমেদ শান্তিতে নোবেল পেলেন পশ্চিমাপ্রীতির কারণে!