ল্যাতিন আমেরিকার চিলির ভ্যালপারাইসো শহরের রাস্তায় গত বছরের ২০ নভেম্বরের নারী-গর্জন শোনা গিয়েছিল। স্প্যানিশ ভাষায় সবাই চীৎকার করে স্লোগান দিচ্ছিল। বলছিল, ‘এল ভিয়োলাদোর এরেস তু’, বাংলায় কথাটির অর্থ হলো: ‘তুমিই ধর্ষক’।
ছাত্রী ধর্ষণের বিরুদ্ধে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দৃশ্যপটে চিলির ব্যাপক প্রতিবাদকে মনে করিয়ে দেয়। কারণ সারা দিনেই ক্যাম্পাস ছিল প্রতিবাদের জ্বলন্ত স্ফূলিঙ্গ। রাতেও সেখানে প্রতিবাদ হয়েছে মোমবাতি জ্বেলে।
আরও পড়ুন: আন্দোলনে গর্জে উঠছে ঢাবি
ছাত্রীদের প্রতিবাদ মনে করিয়ে দেয়, বাংলাদেশের নারীরা কত নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ স্তর থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নারীরাও ধর্ষণের কবল থেকে বাঁচতে পারছেনা। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন কমপক্ষে চারজন নারী ধর্ষিতা হচ্ছে!
বাংলাদেশ বা চিলি নয়, বিশ্বের সর্বত্রই নারীরা প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। উন্নত বা অনুন্নত দেশ নির্বিশেষে নারীরা আক্রান্ত হচ্ছে পাশবিকতার দ্বারা। ফলে চিলি বা বাংলাদেশেই নয়, ধর্ষণ তথা সামগ্রিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আচমকা বিক্ষোভের এক টুকরো চিত্র উঠে আসে কখনও কখনও দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কলকাতার রাজপথের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় নিউ মার্কেটের কাছেও। বিগত বছরে এবং নতুন বছরের সূচনায় নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং এর প্রতিবাদে মুখরিত হয়েছে শহর ও জনপদ।
ফলে ‘ফেমিনিস্ট ইন্টারভেনশন’ বা ‘নারীবাদী হাঙ্গামা’র মাধ্যমে ধর্ষক মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সচেতনতামূলক পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়েই নারীরা রাজপথে আসছেন এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
চিলির নারীবাদী সংগঠন ‘লাস তেসিস’-এর ডাকে সে দেশের মানুষ ধর্ষণ তথা পুরুষতান্ত্রিক হিংসার বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছিলেন সেখানকার মহিলারাদের পাশে দাঁড়িয়ে । পরে ওই গর্জন ছড়িয়ে পড়ে সান্তিয়াগো, মেক্সিকো, আর্জেন্তিনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং লন্ডন, প্যারিস, জার্মানি-সহ নানা জায়গায়।
লাতিন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দিল্লি এবং চেন্নাইয়ের পরে এই আন্দোলন এসে পৌঁছায় কলকাতায়। অংশগ্রহণকারীদের তরফে বলা হয়, ‘চিলির ওই প্রতিবাদের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। সেটা দেখেই আমরা কলকাতায় এ রকম একটা প্রতিবাদের কথা ভাবি। ফেসবুকে ভাবনাটা অজস্র শেয়ারের সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।'
আরও পড়ুন: দিনে ধর্ষণের শিকার ৪ নারী!
ফেসবুক সূত্রে চেনা বন্ধুদের পাশাপাশি অনেক অচেনা বন্ধুও জুটে যান আন্দোলনের রাজপথে। ‘লাস তেসিস’-এর স্প্যানিশ ভাষার কথাগুলোকে নিজেদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় গড়ে নেন তাঁরা। তারপর তা সঞ্চারিত হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিবাদী কর্মসূচির রিহার্সাল চলে তপ্ত রাজপথে।
‘নারীবাদী হাঙ্গামা’ নামের কর্মসূচির পাশে দাঁড়ান কিছু পুরুষ এবং রূপান্তরকামীও। সকলে সমস্বরে ঘোষণা করেন, ‘আমি কী পরেছি, কোথায় গিয়েছি, দোষটা আমার নয়। দোষটা সমাজের, যারা রক্ষণশীল, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, হোমোফোবিক, ট্রান্সফোবিক, পুরুষতান্ত্রিক এবং ফ্যাসিবাদী।' এমন একটি পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থার দিকে সরাসরি অভিযোগ এনে প্রতিবাদকারীরা সাফ জানিয়ে দেন, 'তুমিই ধর্ষক'।
বাংলাদেশ ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন চিলি বা অন্য কোনও দেশের প্রণোদনায় গড়ে উঠেনি। খোদ রাজধানী ঢাকার কুর্মিটোলার জলজ্যান্ত ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ায় চলছে এই ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন। শুধু কুর্মিটোলা নয়, দেশের আনাচকানাচে ধর্ষণের শত-সহস্র ঘটনার উদাহরণ রয়েছে, যে বিষয়ে ছোট-বড় আন্দোলন হয়েছে। এবং বলা বাহুল্য, অধিকাংশ আন্দোলনই ব্যর্থ হয়েছে। ধর্ষিত নারী আরও নিগৃহীত হয়েছে। ধর্ষকের কিছুই হয়নি।
তবু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকার বা সমাজের বিরুদ্ধে ধর্ষণের প্রতিকার চেয়ে আন্দোলন হয়েছে। বাংলাদেশেও হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে মানুষ। বাংলাদেশে যে হারে ধর্ষণ বাড়ছে এবং অভিযুক্তরা বিচারের বাইরে থেকে যাচ্ছে, তাতে এক সময় শুধু ধর্ষকরাই নয়, সমাজের সবাই অভিযুক্ত হবে। ধর্ষণের প্রতিরোধ ও ধর্ষকের বিচার না করতে পারার ব্যর্থতার জন্য সমাজের দিকে আঙুল তুলে যদি অভিযোগ করা হয়, 'তুমিই ধর্ষক', তখন কারোই উত্তর দেওয়ার মুখ থাকবেনা!