ড. রহিথা দাসানায়াকা দাবি করেছেন ইসলামের নবীজিকে জানার জন্য শ্রীলঙ্কা একজন জ্ঞানীকে পাঠিয়েছিল আরবে। ‘আরবস অব সেরানদিপ’ নামের বইটিতে এ দাবি করেন। তিনি শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডির পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। ২০১৮ সালে প্রকাশিত বইটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সেরা বই হিসেবে শ্রীলঙ্কা স্টেট লাইব্রেরি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। গতকাল ২০ জানুয়ারি বইটি নিয়ে কলম্বো সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। খবর জি নিউজ দ্য, ওয়াল ও সাউথ এশিয়ান মনিটরের।
দাসানায়াকা বলেন, “ওই ব্যক্তি দীর্ঘ সফর শেষে মদিনায় যখন পৌঁছান তখন হযরত উমরের শাসনকাল চলছে। তিনি খলিফার সাথে সাক্ষাত করে তার কাছ থেকে নবীর শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন। সফর শেষে ফেরার পথে মাকরান উপকূলে (পশ্চিম পাকিস্তানে) মারা যান। তবে তার সাথে থাকা তার চাকর সেরেনদিপে ফিরে এসে আরবে যা দেখেছেন ও নবী সম্পর্কে যা শুনেছেন তা মুগ্ধকরভাবে উপস্থাপন করেন।”
ইসলাম-পরবর্তী আরব-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক নিয়ে প্রাচীনতম ভাষ্যটি দিয়েছেন ইরানি নাবিক ইবনে শাহরিয়ার (৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি তার বই ‘আজাইব আল হিন্দি’ বা ‘ভারতের আশ্চর্য বিষয়াদি’-তে শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে এসব তথ্য পেয়েছেন বলে দাবি দাসানায়াকার।
এছাড়া ইসলামি ধর্মপ্রচারক খালিদ বিন আবু বাকায়ার কবরে সমাধিফলক পাওয়া গেছে। শ্রীলঙ্কায় এটিই প্রথম আরবি সমাধিফলক। বলা হয়, ইসলামের আবির্ভাবের আগে ও পরে দুপক্ষের আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। অষ্টম শতকে শ্রীলঙ্কা জাহাজ নির্মাণে খ্যাতি কুড়িয়েছিল। সেসময় শ্রীলঙ্কার পক্ষ থেকে আরব শাসকদেরকে জাহাজ উপহার দেওয়া হয়। এছাড়া শ্রীলঙ্কার হাতি, মুক্তা, রুপা, স্বর্ণ ও বিভিণ্ন দুর্লভ পণ্যও আরবদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। বাণিজ্যের জন্য পারস্য উপসাগর ও আরব উপদ্বীপের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। এ সম্পর্ক ১৫তম শতকে পর্তুগিজদের আবির্ভাবে শেষ হয়ে যায়।
বইটিতে বলা হয়েছে, পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ ফারনাও ডি কুয়েরোজ অভিযোগ করেছেন, মুসলিমরা শ্রীলঙ্কায় বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ করে আসছে। পর্তুগিজরা মুসলিম বণিকদের বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেয়েছিল। তাদেরকে দমন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। যেটি ভারতীয় বণিকরা ছিলেন না। পর্তুগিজ ভারত হচ্ছে ভারতবর্ষে পর্তুগাল ঔপনিবেশকতার দরুন দখলকৃত স্থানসমূহ নিয়ে গড়ে ওঠা এলাকা। ইংরেজিতে পর্তুগিজ শাসনাধীন এই এলাকার নাম হচ্ছে পর্তুগিজ ভাইসরয়াল্টি অব ইন্ডিয়া, পর্তুগিজ ভাষাতে এই এলাকার নাম হচ্ছে ভাইস-রেইনো দ্য ইন্ডিয়া। পর্তুগিজ পরবর্তীতে এই এলাকার নাম সরাসরি পর্তুগিজ স্টেট অব ইন্ডিয়া বা Estado Portuguesa da Índia নামকরণ করে।
১৪৯৮ সালে ভারতবর্ষে পর্তুগিজরা আসে। ২০ মে, ১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামার নেতৃত্বে পর্তুগিজ জাহাজ বহর কালিকটের (বর্তমান কোজিকোড়ে) কাপ্পাড় এলাকাতে অবতরণ করে। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজ-ভারতের সরকার গঠিত হয়। পর্তুগিজ শাসকদের ভাইসরয় উপাধিতে ডাকা হতো। ভারতবর্ষে নিযুক্ত প্রথম ভাইসরয়ের নাম ফ্রান্সিসকো দ্য আলমেইদা। ভারতবর্ষে পর্তুগিজ শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোচি। ১৭৫২ সাল পর্যন্ত ভারত মহাসাগরের সকল পর্তুগিজ অভিযান এই কোচি থেকেই পরিচালিত হতো।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত বর্ষ ছেড়ে গেলে পর্তুগিজরা রয়ে যায়। পর্তুগিজ ছিটমহল হিসেবে গোয়াসহ কিছু এলাকা ভারত ভূখণ্ডে রয়ে যায়। ১৯৫৪ সালে ভারত গোয়াসহ আরো কয়েকটি জায়গা পুনরুদ্ধার করে নেয়। ডিসেম্বর ১৯৬১ সালের মধ্যে সকল পর্তুগিজ এলাকা ভারত শাসনে চলে যায়। ১৯৭৫ সালে পর্তুগিজ সরকার ভারতবর্ষ থেকে তাদের দাবি অধিকার সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নেয়।
কিন্তু পর্তুগিজরা চলে গেলে নতুনরূপে স্বাধীন ভারতে অনেকটা সত ভাইয়ের মতো আচরণ শুরু করে ভারত। যে কারণে শ্রীলঙ্কার সাথে ভারতের সম্পর্ক নষ্ট হয়। জন্ম নেয় তামিল টাইগার্স গ্রুপ। দীর্ঘদিন চরমপন্থী ভারতবিদ্বেষী মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীবগান্ধী হত্যার পেছনে শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদেরই দায়ী করা হয়। সব মিলিয়ে চীনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক ভালো হওয়ার পেছনেও একটা কারণ ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের অবনতি।
দেশটির রাজনৈনিক বিশ্লেষক দেভেনা গিয়াতি মনে করেন, এখন আবার শ্রীলঙ্কা চাচ্ছে আরববিশ্বের সঙ্গে ব্যবসা ভালো করতে। কূটনৈতিক বন্ধুত্ব জোরালো করতে। আর তাই এ বইকে আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে। পুরস্কৃত করা হয়েছে। একটি বইও যে হয়ে উঠতে পারে দুদেশের সম্পর্ক রক্ষায় ভালো মাধ্যম—এটি তারই প্রমাণ।