বাংলাদেশের সামাজিক জীবনের ঘটমান বাস্তবতায় সামগ্রিক ভাবে সহিষ্ণুতা/অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সহজেই দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের জীবনে সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতার ভারসাম্য যথাযথভাবে রক্ষিত হচ্ছেনা। পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজের সর্বত্রই চাপা উত্তেজনা ও অসহিষ্ণুতা কারণে প্রায়শই মানুষের স্বাভাবিক আচরণ ও কার্যক্রমসমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
উদাহরণ হিসাবে শত শত ঘটনা সামনে আনা যায়, যাতে সহিষ্ণুতার অভাব ও অসহিষ্ণুতার প্রকাশ স্পষ্ট। 'যে সয় সে রয়' বলে যে একটি বিজ্ঞ-বচন ঐতিহাসিকভাবে আমরা জেনে এসেছি এবং যাতে সহ্য গুণ ধারণ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, তা-ও যেন কার্যকারিতা হারাচ্ছে। এখন, অতি দ্রুত শর্টকাটে, গায়ের জোরে সবকিছু পেতে সহিষ্ণুতা ও সহ্য ক্ষমতাকে পদদলিত করে দেখানো হচ্ছে চরম অসহিষ্ণুতা।
ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-পেশাগত জীবন তথা সর্বক্ষেত্রে সহ্যহীনতা ও অসহিষ্ণুতার জন্য বিরাট বিরাট সমস্যা হচ্ছে। খুন, মারপিট, হিংসা, বিদ্বেষ হচ্ছে। সংঘটিত হচ্ছে চাঞ্চল্যকর-রোমহর্ষক অপরাধ।
কিন্তু কেন সমাজে মানুষের মধ্যে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা? এর পেছনের কারণগুলো কি? এসব প্রশ্নের উত্তর বের করার জন্য সমাজতাত্ত্বিক ও মনোবিজ্ঞানীদের তৎপর হওয়ার মতো পরিস্থিতি এসে গেছে। অসহিষ্ণুতাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবিধান দেওয়ারও সময় উপস্থিত।
কোনও কোনও সমাজ বিশ্লেষকের মতে, বস্তুগত জীবনের নানা হাতছানি, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধের পরিবর্তন অসহিষ্ণু সামাজিক মনের জন্ম দিচ্ছে এবং নানা অপরাধমূলক বিকৃতিতে সেসবের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
কথাটি খুবই সত্য। প্রতিদিনের জীবন-যাপনে, পথে-ঘাটে, কর্মস্থলে কী ভাবে এই অসহিষ্ণুতা বিস্তৃত হচ্ছে, তা সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। ছোট্ট ও সামান্য ঘটনা থেকে বড় বড় ঘটনার জন্ম নিচ্ছে এভাবেই। অসহিষ্ণুতার কারণে পরিণাম ফল সম্পর্কে না ভেবে করা হচ্ছে অবিমৃষ্যকারী আচরণ।
একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাওয়া যায় যে, অসহিষ্ণুতার বাস প্রাত্যহিক জীবনযাপনে। আর এর উৎস নিহিত অনিয়ম ও অসাম্যের কাঠামোগুলোতে। তাই কেবলমাত্র নৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে এর অবসান সম্ভব নয়, প্রয়োজন সুবিচারের নীতি প্রতিষ্ঠা করা।
তদুপরি, সমাজে ও গণমাধ্যমে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহনশীলতার আলোচনা হ্রাস পাওয়াও সমস্যাটি বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ায় দলের ভেতরে ও বাইরে সহিষ্ণুতার মূল্যবোধ ধারণ করতে না পারলেও বিপদ বাড়ে। উন্নয়নশীল দেশে এসব বিপদ সব সময়ই সমাজ ও মানুষকে ঘিরে রাখে।
একটি বহুত্ববাদী, উদার, গণতান্ত্রিক জাতি-সমাজ গঠনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যে ধরনের টানাপড়েন চলতে থাকে তাতে অসহিষ্ণুতার নানা ক্ষেত্র নির্মিত হয়। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণের চ্যালেঞ্জের পথ পাড়ি দিতে হয় বহু স্বার্থ গোষ্ঠীর অসহিষ্ণু অবস্থানকে ডিঙিয়ে। কখনও লিঙ্গ চেতনার লড়াই, সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব, আবার কখনও শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার পরিসরে দলগত রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যেও বাই-প্রডাক্ট হিসাবে অসহিষ্ণুতার উদ্ভব হয়।
সর্বোপরি, ঔপনিবেশিক ও স্বৈরতান্ত্রিক অতীতের গহ্বর থেকে বের হয়ে আসতে যেমন প্রয়োজন দীর্ঘ সময় ও প্রক্রিয়া, তেমনি দরকার অতীতের ঐতিহ্য লালিত অসহিষ্ণুতার (অপ) সংস্কৃতিকে নস্যাৎ করা। ফলে সমাজে সহনশীলতার পরিবেশ নির্মাণে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক উপাদানের পাশাপাশি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক নানা অঙ্গনের গুরুত্ব ও প্রভাবকে অস্বীকার করলে চলবে না। বরং সবাইকে নিয়েই সমাজ, মানুষ ও রাজনীতির সর্বক্ষেত্র থেকেই অসহিষ্ণুতার বিষবৃক্ষকে উৎপাটিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সামাজিক শান্তি ও ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য এ কাজটি যত দ্রুত করা যায়, ততই মঙ্গল।