১৭৯৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর গালিব যখন আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন, তখন ভারতবর্ষে চলছে পরাক্রমশালী মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ দশা। বাবর থেকে আওরঙ্গজেবের শাসনে বিস্তৃত সুবিশাল ভূভাগ কমে সীমাবদ্ধ হয় দিল্লি এবং আশেপাশের সংক্ষিপ্ত এলাকায়।
১৮৫৭ সাল নাগাদ পুরো ক্ষমতা চলে আসে দখলদার ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির কব্জায়। ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়ায় ব্রিটিশদের নারকীয় তাণ্ডব দিল্লিতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সফল হয়।
গালিব দেখেন তার প্রিয় শহর উপদ্রুত। রাজকীয় পরিবারের সদস্যরা নিহত। দরবার ও পুরনো নিয়ম গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। বন্ধু-বান্ধবগণ নির্বাসনে। দিল্লির চাঁদনিচকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। তার দিন কাটে দারিদ্র্য ও ভীতিতে মৃত্যুদৃশ্য দেখতে দেখতে।
এরই মাঝে ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর রেঙ্গুনে নির্বাসিত ও বন্দি শেষ মুঘল সম্রাট আবদুল জাফর সিরাজুদ্দিন বাহাদুর শাহের মৃত্যু হলে গালিব আরও নিঃসঙ্গ ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ এই সম্রাট শুধু তার শাসকই ছিলেন না, ছিলেন বন্ধু ও সহযাত্রী-কবি। গালিব আফসোসের দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিখলেন, ‘বাহাদুর শাহ একই সঙ্গে কারাগার এবং তার নশ্বর দেহের আধার থেকে মুক্তি পেলেন।’
কিন্তু গালিবের মুক্তি সহজে হয়নি। তিনি হারানো মর্যাদা, ভাতা ফিরে পাওয়ার জন্য পথে-পথে ঘুরতে বাধ্য হলেন। লক্ষ্ণৌ গিয়ে ব্যর্থ হলেন। নতুন শাসক ব্রিটিশদের দফতরে আর্জি জানাতে উত্তর ভারত থেকে সুদূরের কলকাতায় উপস্থিত হলেন এবং সবক্ষেত্রেই চরম ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে তিনি ফিরে আসেন দিল্লিতে। সেই প্রিয় অথচ প্রায়-পরিত্যক্ত শহরেই ধার-দেনা-কর্জ করে কষ্টের জীবন-যাপন করতে থাকেন তিনি। রাজসিক কবিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গ্রহণ করতে হয় প্রায়-দেউলিয়ার অভিশপ্ত জীবন।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯ সালে মির্জা গালিব যখন মারা যান তখন তিনি নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীন ও প্রায়-বিচ্ছিন্ন একজন গুটিয়ে যাওয়া মানুষ। জীবন থেকে চলে যাওয়ার অপেক্ষাই তার একমাত্র অবলম্বন আর স্রষ্টার প্রযত্নেই তার একমাত্র আশ্রয়।
গালিবের শেষ আশ্রয়ের পাশে একটি বিকেল কাটিয়ে আমার চোখে দীন-হীন-জীর্ণ কবরগাহ নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় করুণ রাজনৈতিক ইতিহাসের চালচিত্রই ভেসে আসছিল।
আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছিল উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক উথাল-পাতালের একেকটি অতিকায় ঢেউ।
পাহাড়গঞ্জের হোটেলে ফিরে দিল্লির সে রাতে আমার ঘুম হয় না। ডায়েরির পাতা খুলে অনেক আগে মির্জা গালিবকে নিয়ে রচিত আমার একটি কবিতা পড়তে পড়তে রাত কেটে যায়। পাশের করলবাগের দিগন্ত আলোকিত হওয়ার আগেভাগে দিল্লির জামা মসজিদ থেকে ফজরের আজানের সুরেলা ধ্বনিতে অনিন্দ্য ভোর এসে টোকা দেয় জানালায়। সদ্য-বিগত রাতের গহ্বরে জমা থাকে পুরনো দিল্লির অবহেলিত কবরগাহের অপসৃয়মান ছায়া আর গালিবের উজ্জ্বলতম সান্নিধ্যের স্পর্শ। হৃদয়ে জমা থাকে ঘুমহীন গালিবের শহরের আস্ত একটি রাত জেগে থাকার স্মৃতি, যে শহরের আরেক প্রান্তে কবরের নির্জনায় জেগে আছেন স্বয়ং মির্জা গালিব।
বিষন্ন বাতাসে মিশে গানের সুদীর্ঘ মেঘভেলায় ভাসতে চেয়েছিলে
আমাকে তোমার সাথে নিয়ে উড়ে উড়ে যেতে চেয়েছিলে
ইস্পাহানের আঙুর বাগানের নিঃস্তব্ধ ইবাদতে-
কিন্তু মির্জা গালিব আমাকে আসতে নিষেধ করলেন:
“উপদ্রুত দিল্লি ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না;
দেখো না নগরে পুড়ছে আমার আত্মার পবিত্র পাঠাগার?”
আমি শেষ খেয়া পারাপার ছেড়ে বেতো ঘোড়ার বহর ছেড়ে
বয়সী নৌকার দাঁড় ছেড়ে প্রিয় পাখিদের ডানাগুলো ছেড়ে
লাস্ট ট্রেন ছেড়ে ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছি;
আমার সামনে নিয়ে মৈত্রী চলে গেল, গীতাঞ্জলী চলে গেল-
এখন বিরান স্টেশনে বিষের বাঁশী ছাড়া অন্য কোনো সুর নেই
জাফর শাহের কবিতারা ছাড়া অন্য কোনো কাব্য নেই
গালিবের হাহাকার ছাড়া অন্য কোনো বাষ্প নেই-
আমি কী তাহলে কোনো কারাগারে আটকে গিয়েছি?
কেন তবে ক্রমাগত রাবণের দৈত্যরথে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত হচ্ছি?
প্রচণ্ড ‘না’ শব্দে আমাকে কাঁপিয়ে দিলেন জালালউদ্দীন বলখি রুমি:
Why do you stay in prison
When the door is wide and open?
কারাগার নয়? সব দরজা উন্মুক্ত আর খোলা?
তাহলে যাবার কোনো পথ পাচ্ছি না কেন সামনে বা পেছনে?
লক্ষ্যে স্থির, পন্থা নির্বাচনে চঞ্চল গালিব আবার আমার উজ্জ্বল উদ্ধার:
“শতবার প্রেমের বন্ধন থেকে আমি মুক্ত হলাম
কিন্তু কী করি হৃদয়ই মুক্তির পরিপন্থী।”
হৃদয়ের মুক্তির অপেক্ষা করতে করতে আমি প্রায়ই দিল্লির একটি দরিদ্র
কবরখানার আবছায়া দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি-
যেখানে শায়িত মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব।
আরও পড়ুন:
গালিবের করুণ ও নিঃসঙ্গ শেষযাত্রা
গালিব: পরস্পর-বিরোধী মনোভাব ও দ্বৈত-ব্যক্তিত্বের মানুষ