মির্জা গালিবের কলকাতা
অধুনা বিশ্বব্যাপী মরমী সাহিত্যের প্রতি নতুন করে আগ্রহ দেখা দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে আল্লামা রুমি'র কবিতা এখন বেস্ট সেলার। দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুত বাড়ছে গালিবের পাঠক।
মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ গালিব (২৭ ডিসেম্বর ১৭৯৭-১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯) জন্ম নেন আগ্রায় আর বেড়ে উঠেন দিল্লিতে। ভারতবর্ষের নানা জায়গায় ঘুরলেও তার মৃত্যু হয় ৭২ বছর বয়সে দিল্লিতে। পুরনো দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহের সন্নিকটে এক জীর্ণ কবরগাহে শেষশয্যায় শায়িত আছেন উর্দু ও ফারসি ভাষার শ্রেষ্ঠতম এই কবি ও গজল রচয়িতা।
গালিবকে নিয়ে গল্প, কাহিনী, উপকথার শেষ নেই। বিচিত্র জীবন ছিল তার। আর ছিল সাধারণের চেয়ে আলাদা জীবন-যাপন প্রণালী। তিনি নিজেও ছিলেন ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। চোখের সামনে দেখেছেন রাজনৈতিক পালাবদল। মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠন। মুঘল ভারতের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ঘটিয়ে বহিরাগত ইংরেজদের তাণ্ডবের প্রত্যক্ষদর্শী তিনি।
ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট ও কবি বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি। কবিতা লেখা ছাড়া অন্য কোনও পেশা তিনি জীবন-যাপনের জন্য বেছে নেন নি। চলতেন রাজকোষের মাসোহারার টাকায়।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হলে নতুন ক্ষমতাসীন শাসক ইংরেজের কাছে নিজের মাসোহারার জন্য দেন-দরবার করতে গালিব এসেছিলেন কলকাতায়। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী।
যদিও গালিবের কলকাতা আগমনের কারণ ছিল অর্থনৈতিক এবং তা ছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে বন্ধ হয়ে যাওয়া মাসিক ভাতা পুনরায় চালু করার দাবি জানানো, তথাপি কলকাতার সঙ্গে মিশে আছে গালিব-জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ।
১৮২৮ সালে এসে প্রায় দেড় বছর কলকাতায় ছিলেন গালিব। উর্দু ভাষায় রচিত ‘সফর-এ-কলকাত্তাহ্’-তে তিনি লিখছেন, শিমলা বাজারের কাছে ১৩৩ নং হাভেলিতে থাকতেন তিনি। যার বর্তমান ঠিকানা রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে। কলকাতায় থাকাকালীন, এক কবিসভায় অন্যান্য শায়েরদের সঙ্গে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি একটি শায়েরির ব্যাকরণগত প্রয়োগ নিয়ে।
কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা বিডন স্ট্রিট সবাই চেনেন। সেখানে বর্তমান বেথুন স্কুলের পেছনে বাঁদিকের একটি ছোট্ট রাস্তার নাম বেথুন রো। বেথুন রো গিয়ে মিশেছে বর্তমান রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে, যেখানে একদা বসত করেছিলে উর্দু-ফারসি ভাষার মহাকবি মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ গালিব।
রাস্তার নাম আগে বা বর্তমানে যা-ই হোক, কলকাতার এই এলাকাটি শিমলা বাজার পাড়া অঞ্চল নামে পরিচিত। আর কলকাতার বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রলম্বিত পুরো শহরটিই বিন্যস্ত হয়ে আছে অনেকগুলো পাড়া বা ছোট ছোট এলাকায়।
রাস্তার নাম বদল হলেও কলকাতার শিমলা বাজার/পাড়া নামটি এখনও বিদ্যমান। এখানে এখনও মিশে আছে মধ্যযুগের গৌরবময় ভারতবর্ষের শেষ সাংস্কৃতিক আইকন কবি গালিবের দুঃখময় কাহিনী, যার কতক ঝলক রয়েছে স্বয়ং কবির আত্মজীবনীতে।
আত্মজীবনীর পর্বগুলোতে কবি জানাচ্ছেন শিমলা বাজারের কথা, ১৩৩ নম্বর হাভেলিতে তার বাসস্থানের বিবরণ। জানিয়েছেন সন্নিকটবর্তী চিৎপুর-বড়বাজারের কথাও। বিবৃত করেছেন ঐতিহাসিক এক উক্তিও, 'কলকাতার মতো এমন মন জয় করা জমিন তামাম দুনিয়ার আর কোথাও নেই।'
কলকাতার তৎকালীন কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে গালিবের মোলাকাত ও আলাপ-আলোচনা সুখকর হয়নি এবং তিনি তাদের কাব্যমান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তদুপরি, নিজের মাসোহারা সংক্রান্ত যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন, তা-ও সিদ্ধ হয়নি। তথাপি তিনি কলকাতার সুখ্যাতি করেছেন অকুণ্ঠ চিত্তে এবং তা প্রকাশ করেছেন তার কালজয়ী আলফাজের মাধ্যমে:
'কলকাত্তেকা জো জিকর কিয়া তুনে হম নশিঁ/এক তীর মেরে সিনে মে মারা কে হায় হায়!'
কলকাতাও এই মহৎ কবিকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। শিমলা বাজারের স্মৃতি ছাড়াও গালিবের নাম অক্ষয় হয়ে আছে নিউমার্কেটের পাশের মির্জা গালিব স্ট্রিটে, এক সময় যে রাস্তার নাম ছিল ফ্রি স্কুল স্ট্রিট। পার্ক স্ট্রিট (বর্তমান মাদার টেরেসা সরণি) আর ধর্মতলা স্ট্রিটকে (বর্তমান লেনিন সরণি) যুক্ত করেছে উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত মির্জা গালিব স্ট্রিট।
নিউমার্কেট, সদর স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট, তালতলা ইত্যাদি এলাকা বসবাস ও যাতায়াতের জন্য সুবিধাজনক। নানা মানের থাকার হোটেল আর বাহারি খাবারের আয়োজন কলকাতার এই মধ্যাঞ্চলের অন্যতম বিশেষত্ব। সারা বছরই এখানে গিজগিজ করেন দেশি-বিদেশি পর্যটক। বাংলাদেশিরা কলকাতা ভ্রমণের সময় এসব এলাকাকেই থাকা-খাওয়া-যোগাযোগের সুবিধার কারণে পছন্দ করেন।
যদিও কল্লোলিনী কলকাতার জনারণ্যে প্রসারিত হয়ে আছে মির্জা গালিব স্ট্রিট, তথাপি সাধারণ মানুষের খুব কমই জানেন এই অনন্য কবি সম্পর্কে। লাখো মানুষের ভিড়েও তিনি আছেন নিজস্ব নিভৃতিতে। যেমনভাবে তিনি নীরবে শুয়ে আছে কলকাতা থেকে হাজার মাইল দূরে দিল্লির নিঃসঙ্গ কবরগাহের শেষশয্যায়।