গালিব: দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক আইকন

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

দক্ষিণ এশিয়ায় উর্দু-ফারসি গজল ও কবিতার শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা, প্রাচীন কবি মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ গালিবের (২৭ ডিসেম্বর ১৭৯৭-১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯) সঙ্গে একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি -তাড়িত বিশ্ববাসীর সম্পর্ক ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছে। তার প্রেমময়তা, মরমীবাদ ও কাব্যিক ব্যঞ্জনা আকৃষ্ট করছে একালের মানুষদেরও। বইয়ের পাতার দূরতম অক্ষরের চেয়ে অনেক অনেক কাছে চলে আসছেন তিনি। তিনি গভীর নিবিড়তায় উচ্চারিত হচ্ছেন মানুষের হৃদয়ের মর্মমূলে। অথচ তার সাথে একালের ব্যবধান শতবর্ষের। গেল ১৫ ফেব্রুয়ারিতেই তার মৃত্যুর ১৫১ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।

কবিতা ও গজলে গালিব যে তির্যকতা, রহস্যময়তা, প্রেমময়তার আনন্দ ধ্বনি ও বেদনার আর্তি প্রকাশ করেছেন, মানুষ তা আগ্রহ ভরে শুনছেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় মরমী কবি রুমি যেমনভাবে বেস্ট সেলার, দক্ষিণ এশিয়ায় গালিবকে নিয়েও তেমনভাবে চর্চা বাড়ছে। ভাষিক গণ্ডি পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠছেন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সাংস্কৃতিক আইকন।

বিজ্ঞাপন

গালিবের সঙ্গে আমাদের পরিচয় অনুবাদের মাধ্যমে এবং উর্দু বা ফারসি জানা মাওলানাদের বয়ানের বরাতে। বাংলার সঙ্গে তার যোগাযোগের বিষয়ে কোনও গবেষক বিস্তারিত না জানালেও, গালিব যে কলকাতা পর্যন্ত এসেছিলেন, সে ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১৮২৮ সালে এসে প্রায় দেড় বছর কলকাতায় ছিলেন গালিব। উর্দু ভাষায় রচিত ‘সফর-এ-কলকাত্তাহ্’-তে তিনি লিখছেন, 'কলকাতার মতো এমন মন জয় করা জমিন তামাম দুনিয়ার আর কোথাও নেই।'

কলকাতায় গেলে গালিবের স্মৃতি-ধন্য জায়গাগুলো ঘুরতে ঘুরতে চোখের সামনে যেন ফিরে আসে মুঘল জমানার শেষ আর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শুরুর ইতিহাস-গন্ধী দিনগুলো। মধ্য কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিট বা সিমলা বাজারের পথে-প্রান্তরে গালিবের উপস্থিতির ইতিবৃত্ত টের পাওয়া যায়। কানে বাজে মধ্যযুগের সাংস্কৃতিক সুষমা গালিবের কণ্ঠস্বরের আবছা প্রক্ষেপে।

বিজ্ঞাপন

মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ গালিব জন্ম নেন আগ্রায় আর বেড়ে উঠেন দিল্লিতে। ভারতবর্ষের নানা জায়গায় ঘুরলেও তার মৃত্যু হয় ৭২ বছর বয়সে দিল্লিতে। পুরনো দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহের সন্নিকটে এক জীর্ণ কবর-গাহে শেষ শয্যায় শায়িত আছেন উর্দু ও ফারসি ভাষার শ্রেষ্ঠতম এই কবি ও গজল রচয়িতা।

২০১৯ সালের শরতকালে দিল্লির মেহেরআলি এলাকা পেরিয়ে বস্তি নিজামুদ্দিনের পুরনো কাঠামোতে প্রবেশের সময় সঙ্গে ছিল সদ্য-কলকাতায় গালিব স্মৃতি-ধন্য জায়গাগুলো ছুঁয়ে আসার তাজা স্পর্শ। দিল্লি তখন তপ্ত বায়ু দূষণে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ছাপ পুরো শহরে। আরও ছিল নাগরিকতা নিয়ে উত্তাল জন-বিক্ষোভ।

মোটেও অবাক না হয়ে পায়ে হেঁটে গালিবের কবর-গাহের দিতে যেতে যেতে আমার মনে হয়েছিল, এটাই স্বাভাবিক। যে কবির জীবন কেটেছে যুগ-সন্ধিক্ষণে, বিদ্রোহের আগুন ও বিক্ষোভের বারুদের মধ্যে, তার কাছে যাওয়ার জন্য শান্ত পরিস্থিতি আশা করাও ভুল। কারণ, স্বয়ং গালিব, ঐতিহ্যবাহী দিল্লি নগরে ঔপনিবেশিক শক্তির লুণ্ঠন ও নির্যাতনের সাক্ষী। লাইব্রেরিগুলো পুড়িয়ে সুরম্য নগরকে নরকে পরিণত করার বীভৎসতা তিনি দেখেছেন বুক-চাপা যন্ত্রণায়। এখনও তিনি কবরের নীরবতায় শুয়ে দেখছেন হিংসা ও শক্তির মত্ততা।

অতি সাধারণ একটি পথ-নির্দেশক সাইন বোর্ড না থাকলে গালিবের কবরটি খুঁজেও পাওয়া যেতো কিনা সন্দেহ। দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ ছাড়িয়ে বেশ খানিক এগিয়ে গেলে দেখা পাওয়া যায় গালিবের সাদামাটা সমাধি।গালিবের জীবনের শেষ দিনগুলোর কথা মনে হলে বুঝা যায়, কত অনাদরে ও অবহেলায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক প্রতিভা।

আরও পড়ুন: মির্জা গালিবের কলকাতা