করোনায় মনুষ্যহীন ভুতুড়ে পৃথিবী!

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 18:51:50

'লন্ডন শহর দিনে জনশূন্য আর রাতে ভুতুড়ে', আন্তর্জাতিক মিডিয়ার শিরোনাম এমনই। পৃথিবীতে এমন নিথর, থমথমে, চাঞ্চল্যহীন পরিস্থিতি আগে আর আসেনি। যুদ্ধ ও সঙ্কটেও কিছু জন চলাচল দেখা গেছে। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে তা-ও নেই। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চোখে করোনা আতঙ্কে পৃথিবী এখন 'মনুষ্যহীন ভুতুড়ে'।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন জনশূন্য ও নিশ্চুপ পৃথিবী কখনোই দেখা যায়নি। পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোর চেহারা এখন পরিত্যক্ত জনপদের মতো জনমানবহীন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন নিঝুম পৃথিবীর ছবি কেউ দেখেনি।

অথচ বসন্তের এই সময়ে ইউরোপ মুখরিত থাকার কথা পর্যটকদের পদভারে। দক্ষিণ ইতালির অপরূপ নিসর্গে উৎসব ও আনন্দের ফোয়ারা বইয়ে যেতো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। এখন সেখানে মৃত্যুপুরীর হাহাকার।

খা খা করছে নর্থ সি, নরমান্ডির উপকূল। কাম্পিয়ান সাগর, মেডিটেরিয়ান সি, বাল্টিক সাগর, অড্রিয়াট্রিক সাগরের নীল জলরাশিতে কেবলই শূন্যতা। সেখানে নেই কোনও প্রমোদতরী, আছে শুধু নিরবতা। সাইপ্রাস, কাপ্রি দ্বীপের বিশ্রামাগারগুলোতে প্রাণের কোনও স্পন্দনই নেই। মানব উপস্থিতির কোনও চিহ্নই নেই চরাচরে।

প্রত্নঐতিহ্যে নিঃসীম নিরবতা, ছবি: সংগৃহীত

প্যারিসের নান্দনিক শোভা দেখার জন্য কেউ ঘরের বাইরে নেই। ইতালি, গ্রিসের প্রত্ন ঐতিহ্যের সুপ্রাচীন কাঠামোতে মিশে আছে একাকীত্ব ও নৈঃশব্দের স্তব্ধ প্রচ্ছায়া। ইউরোপের প্রাচীন এভিনিইগুলোতে শোনা যাচ্ছেনা একটিও পদশব্দ।

আটলান্টিকের অপর তীরের আমেরিকা, কানাডার বিশ্ববিখ্যাত শহরগুলোতেও অভিন্ন নিরবতার ছবি ভাসছে। কসমোপলিটান হুল্লোড়ে বরফ শীতল স্তব্ধতা। মেট্রোপলিটন জীবনে মনে হচ্ছে হেঁটে বেড়াচ্ছে একটি-দু'টি প্রেতাত্মা।

প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের তীরের শত শত দেশ স্থবির হয়ে আছে। বন্ধ সীমান্ত, বিমানবন্দর, পোতাশ্রয়। নগরগুলো লকডাউনে প্রায়-বন্দি। আইসোলেশন, কোয়ারান্টাইনের কবলে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে চিরচেনা জীবন ও জগত থেকে। করোনায় বদলে গেছে পৃথিবীর চিরচেনা ছবি।

বন্ধ হয়ে গেছে সীমান্ত, প্রার্থনালয়, মল, বিপনি-বিতান, অপেরা, স্টেশন, স্টেডিয়াম। মসজিদ, চার্চ, সিনাগগে নেই জন সমাগম। স্কুল, কলেজ বন্ধ। অনেক অফিস বন্ধ করায় বাসা থেকে কাজ করছে লোকজন।

খা খা খালি পড়ে আছে সব আয়োজন, ছবি: সংগৃহীত

আতঙ্কের সমার্থক কিছু শব্দ বার বার ঘুরে ঘুরে আসছে ২০২০ সালের করোনাভাইরাস কবলিত বিশ্বে। প্যানিক, ট্রমা, ডিপ্রেশন, ম্যালিনকোলি, এলিনিয়েশান, ফিয়ার দখল করেছে পৃথিবীর ভোকাবোলারি। মানুষ পড়ছে অতীতের বৈশ্বিক মহামারী প্লেগ, ম্যালেরিয়া, কলেরা, কালোজ্বর নিয়ে রচিত গবেষণা ও উপন্যাস। আর মিলিয়ে দেখছে নিজেদের দুর্ভাগ্য। দেখে আতঙ্কে পাণ্ডুর হয়ে যাচ্ছে। কারণ অতীতের ভীতি ও বিপদের চেয়ে বহুগুণ বিধ্বংসী শক্তিতে হাঙরের মতো মৃত্যুমুখ বাড়িয়েছে করোনাভাইরাস।

কেউ জানেনা, কতদিন চলবে এই অচলাবস্থা আর মৃত্যুর মিছিল। চীনের যে উহান শহর থেকে বিপদের শুরু, সেখানকার পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বিপদ ছড়িয়ে গেছে সমগ্র বিশ্বব্যাপী। ইতালি, স্পেন, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র হয়ে বিশ্বের প্রায় দেড় শতাধিক দেশে অক্টোপাসের মতো হামলা করেছে করোনাভাইরাস।

প্রায়-প্রতিটি দেশেই দু-চারজন লোক মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে বহুজন। একবার ছড়িয়ে গেলে করোনা গাণিতিক হারে লাফিয়ে চলে। দুই, চার, ষোল, বত্রিশ করে করে শত শত, হাজারে পৌঁছায়। মানুষকে তাই সবিশেষ সতর্ক থাকতেই হচ্ছে অচেনা ও প্রতিষেধকহীন মরণ ভাইরাসের কবল থেকে।

করোনার কারণে চিরচেনা, প্রিয় পৃথিবীতে থেকেও মানুষকে সরে থাকতে হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার জনসংযোগহীন বিবরে। পৃথিবী আর তার প্রিয়তম অধিবাসী মানুষের সঙ্গে এতো দূরত্ব ও সম্পর্কহীনতা কেউ কখনো কল্পনাও করেনি। কেউ জানেনা, কবে ঘুচবে এই বিচ্ছেদ। প্রাণে প্রাণে আবার কবে মানুষের পদভারে মুখরিত হবে সবুজ পৃথিবী, কেটে যাবে নীল আতঙ্কের অন্ধ-প্রহর, কেউ জানেনা।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর