যে শহর কখনো ঘুমায় না, সব সময় জেগে থাকে, সেই নিউইয়র্ক এখন মৃত্যুপুরীর মতো নিস্তব্ধ, ঘুমন্ত। বিশ্বের সব জাতির বিচিত্র সমাবেশে নিউইয়র্ক এক আন্তর্জাতিক কসমোপলিটান, যাকে ডাকা হয় 'বিগ অ্যাপেল' নামে। করোনাভাইরাসের আক্রমণে সদা-জীবন্ত নিউইয়র্কে এখন শুধুই হাহাকার আর মৃত্যুর হাতছানি।
১৫২৪ সালে গোড়াপত্তন হওয়া নিউইয়র্ক ১৭৯০ সাল পর্যন্ত ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী। প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটের অভিষেক হয়েছিল নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের ফেডারেল ভবনে। ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা পর আবারও করোনাভাইরাসের কারণে চরমভাবে আক্রান্ত হলো পাঁচশ বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক শহর।
ইতালীয় অভিযাত্রী জোভান্নি দ্যা ভেরাৎসানো সর্বপ্রথম এখানে আসেন ফ্রান্সের রাজার প্রতিনিধি হয়ে। স্থানীয় লেনাপি আদিবাসী জাতিকে হটিয়ে এই জায়গার নাম রাখা হয় তখন দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের এক শহরের নামে 'নুভেল অঁগুলেম' বা নতুন অঁগুলেম।
তারপর নিউইয়র্ক আসে ওলন্দাজদের হাতে। ১৬১৪ সালে তারা ম্যানহাটনে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করেন আর শহরের নতুন নাম দেন 'নতুন আমস্টারডাম'। ১৬৬৪ সালে ব্রিটিশরা শহরটি দখল করে নতুন নামকরণ করে ইংল্যান্ডের ইয়র্কের সঙ্গে মিলিয়ে নিউইয়র্ক।
নিউইয়র্ক শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল, বহুজাতিক ও বহুসংস্কৃতির শহর। এই বিশ্বনগরীতে সব ধরনের ধর্ম, গোত্র, বর্ণের মানুষের বসবাস। নিউইয়র্কে তেল আবিবের চেয়েও বেশি ইহুদি, ডাবলিনের চেয়েও বেশি আইরিশ, নেপোলির চেয়েও বেশি ইতালীয়, সান হুয়ানের চেয়েও বেশি পুয়ের্তোরিকান বাস করেন। এই শহরের মানুষ ৮০০ শতাধিক ভাষায় কথা বলে, যার অর্থ হলো বিশ্বের প্রায়-সকল ভাষাভাষী মানুষের কোনও না কোনও সদস্য এখানে রয়েছেন।
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্বের মতোই নিউইয়র্ক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্পদশালী মহানগরী। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বহু প্রতিষ্ঠান ও জাতিসংঘের সদর দপ্তর এখানেই। মার্কিন জাতির আইকন যেন নিউইয়র্ক। নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট বললেই ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্রডওয়ে বললেই মঞ্চনাটক, ফিফথ এভিনিউ বললেই মার্কেটিং, ম্যাডিসন এভিনিউ বললেই মিডিয়া-বিজ্ঞাপন, গ্রিনিচ ভিলেজ বললেই বোহেমীয় জীবনচিত্র, সেভেনথ এভিনিউ বললেই ফ্যাশান-পোষাক শিল্প, ট্যামানি হল বললেই কূটনীতি-রাজনীতি, হারলেম বললেই জ্যাজ সঙ্গীতের আদিযুগ ও আফ্রিকান-আমেরিকান জীবনের বহুমাত্রিক প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে।
বিশ্বের চারটি দিক থেকে আগত অভিবাসীদের স্বাগত জানিয়েছে 'সিটি অব ইমিগ্রেন্টস' নিউইয়র্ক, যেখানে সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার ফরাসি সৌরভ নিয়ে দণ্ডায়মান 'স্ট্যাচু অব লিবার্টি'। নিউইয়র্ক নিজেই যেন নিজের উপমা। লোয়ার ম্যানহাটনে আকাশচুম্বী অট্টালিকার মিছিলে আর্ট ডেকো ধাঁচের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, স্কাইসলার বিল্ডিং ইত্যাদি গগনবিস্তারী অট্টালিকা গুচ্ছের নিউইয়র্ক শহরের দিগন্তরেখাকে ঐশ্বর্য ও খ্যাতির আইকনে পরিণত করেছে। নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের অট্টালিকাদ্বয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমৃদ্ধির মুকুটে সোনার পালকের মতো উজ্জ্বল।
সেই নিউইয়র্কে এখন মৃত্যুর শীতলতা। চীনে উদ্ভূত প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ইরান, ইউরোপ হয়ে আঘাত করেছে যুক্তরাষ্ট্রে আর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে নিউইয়র্ক। করোনার আক্রমণে মৃত্যু ও আতঙ্কের শহরে পরিণত হয়েছে প্রাণবন্ত নিউইয়র্ক, যেখানে বসবাসকারী বহু বাংলাদেশির মৃত্যুর সংবাদও পাওয়া গেছে।
করোনায় নিউইয়র্কে প্রাণহানি ও আক্রান্তের সংখ্যা তো বাড়ছেই, সেই সাথে বাড়ছে খাদ্য সঙ্কট, আতঙ্ক, ভীতি ও উৎকণ্ঠা। বসবাসের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুবিধা বহুল শহরের জীবন এখন সীমাহীন কষ্টের নামান্তর। স্বপ্নতুল্য নাগরিক প্রলোভনের মহানগরে এখন দুঃস্বপ্নের প্রহর। করোনার আঘাতে বিশ্বশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দম্ভ ভূলুণ্ঠিত আর ঐতিহ্যময় নিউইয়র্কের অস্তিত্বের সামনে উপস্থিত ঘোরতর সঙ্কট ও সন্ধিক্ষণ।