২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় ক্যালেন্ডারে ছিল ডিসেম্বর মাস আর ঋতুচক্রে শীতকাল। তারপর আসে ২০২০ সাল। আসে ঋতুরাজ বসন্তকাল। করোনাও মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।পৃথিবীতে নিয়ে আসে এক স্মরণীয় বসন্ত ঋতু, যা কোনোদিন ভুলতে পারবেনা কেউ।
সঙ্গরোধ ও সামাজিক দূরত্ব ডেকে আনা করোনা পরিস্থিতিতে প্রকৃতি থেমে থাকে না। শীতের ঝরা পাতা ফেলে নতুন পত্র, পুষ্প, পল্লবে নবসাজে সজ্জিত হয় বাসন্তী আবহে। মানুষের চলাচল হ্রাস পাওয়ায় কমে দূষণ। বাতাস হয় শুদ্ধতম। আকাশ আরও অনেক নীল। প্রকৃতি উপহার দেয় পূর্ণতায় আচ্ছাদিত এক নিটোল বসন্ত।
জনমানুষের পদচারণা না থাকায় প্রকৃতি নিজের মতো বিকশিত হয় কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই। সৈকতের প্রলম্বিত ভূগোলে শৈবাল, লতা, গুল্ম ছড়িয়ে পড়ে। বালুকা বেলায় নির্বিঘ্নে খেলা করে শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ। উপকূলের সুনীল জলে আনন্দে মাতোয়ারা হয় শুশুক, ডলফিন।
বনে বনে অবারিত সৌন্দর্যে জাগে প্রকৃতির প্রতিটি সদস্য। বৃক্ষের শাখায়, পাতায়, ফুলে, মুকুলে জাগে প্রাণের বন্যা। লতায়, ঘাসে, ঝোপঝাড়ে জীবনের নতুন স্পর্শ লাগে।
দূষণমুক্ত অবারিত আকাশে শুধু নীলের মেলা আর পাখিদের কোলাহল। মানুষের অবিমিষ্যকামিতায় যেসব পাখি হারিয়ে গিয়েছিল, ফিরে আসে তারাও। সঙ্গে নিয়ে আসে একঝাঁক প্রজাপতি, পতঙ্গ, মথের উচ্ছ্বলতা।
শুধু প্রাচ্যের পৃথিবীতে নয়, প্রতীচ্যের ভূমিতটের নিরবতায় দেখা পাওয়া যায় এক আদি ও অকৃত্রিম বসন্তের। ইউরোপকে ঘিরে রাখা সমুদ্র ও হ্রদগুলো এবং প্রসারিত কানন ও বনাঞ্চলে দৃশ্যমান হয় এক পরিপূর্ণ বসন্তের। করোনাভাইরাস আক্রান্ত পৃথিবীতে ঘরবন্দী মানুষ বিস্ময়ের চোখে দেখে এক সর্বাঙ্গসুন্দর বসন্ত ঋতু।
এতো অনাবিল, এতো পরিস্ফুট, এতো বিকশিত, কখনো না দেখা এমন পরিপূর্ণ বসন্ত ধীরে ধীরে অতিক্রান্ত হয় চরম নিঃসঙ্গতায়। স্মরণীয় এই বসন্তকে মনে হয় বড়ই অতৃপ্ত। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ না হলে কিংবা উৎসবের আমেজ না মিশলে কোনো ঋতুই সফল হতে পারেনা। অরণ্যের বিশালতায় একজনও শকুন্তলা না থাকলে সুন্দর প্রকৃতিও প্রাণ পায় না। কোনো পথিক যদি পথ না হারায় সেই অরণ্যে, তাহলেও জীবন্ত হয়না প্রকৃতি।
করোনার পৃথিবীতে সর্বাঙ্গীণ প্রাপ্তিতে ভরপুর বসন্ত ঋতুর আরেক পিঠে তাই ছায়া পড়ে প্রলম্বিত অপ্রাপ্তির। মানুষ ও উৎসবের সংশ্লেষহীন এমন ভরাট বসন্তকেও মনে হয় প্রাণহীন। পৃথিবীর ইতিহাস প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির দোলাচলের এমন বসন্ত আর কখনোই দেখেনি। করোনার ভীতিপ্রদ পরিস্থিতিতে মানুষের ছোঁয়া না পেয়েই গড়াতে থাকে এমনই স্মরণীয় বসন্তকাল। সভ্যতার ইতিহাসে বড্ড আলাদা ও ভীষণ অন্য রকম পরিচিতে চিহ্নিত হয় ২০২০ সালের বসন্ত ঋতু।
বসন্তকে নিয়ে রচিত শত শত গান, কবিতা, চিত্রমালা এমন যৌবনদীপ্ত বসন্তেও মনে হয় অর্থহীন। মানুষ আর উৎসববিহীন বসন্তকে মনে হয় বিরহী প্রেমিকার মতো বেদনার্ত। এই বসন্তের সর্বাত্মক উজ্জ্বলতার আড়ালে বয়ে যায় বিষাদের অন্তঃস্রোত। মানুষের মনেও আবর্তিত হয় বসন্তের স্পর্শহীনতার প্রচণ্ড দুঃখবোধ।
শিল্পী ও চিত্রকরের কল্পনায় স্মরণীয় অথচ নিঃসঙ্গ এমন বসন্ত জাগায় ভিন্নতর অভিঘাত। কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পী প্রীতিশ্রী রায় অকপটে প্রকাশ করেন সেই অভিব্যক্তি: 'বড্ড মন কেমন করছে l অন্যবার বসন্ত মানেই কতো আনন্দ, উৎসব, রঙের খেলায় মেতে ওঠা l এবার এক ভীষণ মন খারাপ করা আনন্দহীন, গৃহবন্দী, ভয়ে কাতর জীবন কাটাচ্ছি আমরা l বসন্ত আছে তারই মতো l আমরা ছুঁতে পারছি না তার সৌন্দর্য l তাই এই ছবিটা এঁকে ফেললাম।'
শিল্পী তার অঙ্কিত এমন অপরূপ ও অন্য রকম বসন্তের চিত্ররূপের শিরোনাম দিয়েছেন 'নষ্ট বসন্ত'। কিন্তু প্রকৃতি, নিসর্গ, ঋতু কিংবা মানুষ কখনো নষ্ট হয়? নানা আরোপ, বিরূপতা ও দূষণ তাকে পঙ্কিল করলেও তার শাশ্বত সত্তা অমলিন। তাকে শত চেষ্টা করেও নস্যাৎ করা যায় না। প্রাণের আলোয় জেগে উঠেই। হয়ত অনির্বচনীয় এই বসন্ত নিঃসঙ্গ এবং মানুষের সঙ্গে সংযোগ সম্পর্কহীনতায় খুবই কষ্টের, কিন্তু নষ্ট নয় কিছুতেই।