করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে ঘরবন্দী থাকা। সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা। এবং ততদিন পর্যন্ত, যতদিন করোনার প্রকোপ না কমে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও একই পরামর্শ। এ অবস্থায় সরকার জনগণকে ঘরে থাকার আহবান জানাচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরুতে নিরুৎসাহিত করছে। জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিবেচনায়, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও দীর্ঘ লকডাউনে। অফিস-আদালত, কলকারখানা, পরিবহন, সুপার মার্কেট, রেস্তোরাঁ, জনগসামগম, সব বন্ধ।
ভাইরাসটি বাংলাদেশেও ভীষণ আতংক ছড়িয়েছে। করোনায় ইতোমধ্যেই বিশ্বে ২ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আক্রান্ত প্রায় ত্রিশ লাখের বেশি। আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। করোনার আক্রমণে বিশ্ব তছনছ। অর্থনীতি স্থবির। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। উন্নত-অনুন্নত সব দেশের সরকারের অবস্থা শোচনীয়; রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুঅর্থেই।
জীবন বাঁচাতে ঘরে থাকতে হবে। জীবিকার জন্য লকডাউন তুলে নিতে হবে। এই হচ্ছে বাস্তবতা। অনেকদেশেই লকডাউন তুলে নিতে সরকারের ওপর তীব্র চাপ রয়েছে। অ্যামেরিকায় বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও লকডাউন তুলে নেবার দাবি জোরালো হচ্ছে। সরকারের পক্ষেও দীর্ঘদিন কোটি কোটি মানুষকে খাওয়ানো কঠিন। সত্যি বলতে সেই সামর্থ্যও বাংলাদেশের নেই।
তাহলে উপায়? যাদের ঘরে খাবার আছে, চাকরি বা অর্থের নিশ্চয়তা আছে তারা লকডাউন চালিয়ে যাবার পক্ষে। কিন্তু শ্রমিক, পরজীবী, বস্তিবাসি এবং সঞ্চয় শেষ এমন মানুষের জন্য লকডাউন মানা কঠিন। ঢাকার রাস্তায় এখনই অভাবী-অনাহারী মানুষের ভিড়। কোথাও কোথাও খাবারের দাবিতে বিক্ষোভও হয়েছে। ঘটেছে ত্রাণের ট্রাক লুটের ঘটনাও। অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতি সরকার ও জনগণ উভয়ের জন্যই অস্বস্তির এবং কঠিন।
লকডাউন তোলার যুক্তি হচ্ছে, করোনায় মৃত্যু হার কম। তাই সব বন্ধ রেখে অর্থনীতি বিপর্যস্ত করা অর্থহীন। লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে করোনায় না মরলেও, মানুষ ক্ষুধায় মরবে। অন্যপক্ষের যুক্তি, মানুষের জন্য অর্থনীতি। মানুষ না বাঁচলে অর্থনীতি দিয়ে কী হবে? সুতরাং করোনা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত লকডাউন চালিয়ে যাওয়া উচিত। এ মুহূর্তে, দেশের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে জনস্বাস্থ্য না অর্থনীতি?
এ প্রশ্নের সহজ কোনো মীমাংসা নেই। সম্প্রতি অ্যামেরকিার, ন্যাশনাল ইন্সটিউট অব হেলথ মেরিল্যান্ডের প্রোগাম লিডার আনন্দলাল রায় এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটক আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা তাদের একটি যৌথ নিবন্ধে বলছেন, “জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিকল্প নয়, তবে অন্যতম সহযোগী। করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্যের সংকট। যতদিন না স্বাস্থ্যের সংকট কাটবে, মন থেকে ভয় দূর হবে, ততদিন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে না। জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতিকে আলাদা করা যায় না বলেই কোনটা আগে এর উত্তর খুঁজে লাভ নেই।”
জনস্বাস্থ্যের সাথে জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কিত। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিগ্রস্ত হলে সমাজে আতংক ও গুজব ছড়ায়। অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এতে সবচেয়ে ক্ষতি হয় দরিদ্র মানুষের। তাই জনস্বাস্থ্য সবসময় সরকারের সর্বোচ্চ মনোযোগ দাবি করে। একইসাথে লকডাউন সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি, ক্ষুধার্তের আহাজারি, প্রনোদনার দাবি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সরকারের পক্ষে।
সবচেয়ে ভালো হতো, যদি জনস্বাস্থ্যের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক মডেল থাকত। দুনিয়াজুড়ে অভিযোগ উঠছে, জনস্বাস্থ্যকে অবহেলার কারণেই বিশ্ব আজকে ‘জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি’ উভয়ক্ষেত্রেই করুণ পরিণতি দেখছে। বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কংকাল বেরিয়ে এসেছে করোনার আঘাতে। শুধুমাত্র রাষ্ট্রনায়কদের উদাসীনতায় করোনা এতটা প্রাণঘাতী হয়েছে। আরো কত মানুষের প্রাণ নেবে তা ভবিষ্যত বলবে। তবে প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত যে বিশ্বকে ভোগাবে সেটা স্পষ্ট।
যে কারণে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বকে সতর্ক করে বলছে, এই ভাইরাস এখনো অচেনা। প্রতিষেধকও নেই। তাই নিয়ম না মানলে এই শত্রুই ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
অন্যদিকে জাতিসংঘের আশংকা, চলমান অতিমারির জেরে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে। বিশ্ব খাদ্য সহায়তা কর্মসূচীর মুখ্য অর্থনীতিবিদ আরিফ হুসেইন ইঙ্গিত দিয়েছেন, “এ বছর ১৩ কোটি লোক খাদ্য ঝুঁকিতে আছে। এখনই ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বিশ্বে প্রায় ২৭ কোটি মানুষকে অভুক্ত থাকতে হতে পারে।” এর বেশিরভাগই যে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। ফলে জাতিসংঘ জোর দিচ্ছে, নাগরিকদের সুস্থ রেখে কিভাবে অর্থনীতিকে সচল করা যায়, তার ওপর। বিশেষ করে ভাবতে বলছে, ‘দিন-আনি-দিন-খাই’ মানুষদের কথা।
প্রশ্ন হচ্ছে, কতদিনে করোনা বাগে আসবে? লকডাউনেই বা কতদিন চালানো যাবে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, করোনা পরিস্থিতি প্রলম্বিত হবে। এবং ২০২১ সালের আগে এর ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এমন পরিস্থিতিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অভিজিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় বলছেন, অ্যামেরিকা-ইউরোপ বা কোনো দেশের পক্ষেই দীর্ঘদিন লকডাউন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ শুরু করতে হবে। এতে কিছু ভুল হবে। কিছু মানুষের জীবনও বিপন্ন হবে। ভুলগুলো মেনে নিতে হবে। এ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না।
তবে লকডাউনের সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। এ সময় সরকারের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে গরিব, কর্মচ্যূত, বাস্তচ্যূত মানুষ এবং ছোট-মাঝারি-বড় ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রনোদনার ব্যবস্থা করা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু গরিব-ধনী কারো হাহাকার থামেনি। বিভিন্ন খাত থেকে আরো প্রণোদনার দাবি উঠছে। কিন্তু এত অর্থের যোগান কিভাবে হবে? অভিজিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের সমাধান হচ্ছে, যত বেশি সম্ভব প্রণোদনা দিতে হবে। প্রয়োজনে টাকা ছাপিয়ে দিতে হবে। যেটা অ্যামেরিকা-ইউরোপের দেশগুলো করছে। তাঁর মতে, মানুষ হাতে টাকা পেলে, কিছু কেনাকাটা করতে পারবে। এতে অন্তত অভ্যন্তরীণ চাহিদাটা ধরে রাখা যাবে। সম্প্রতি ‘ব্র্যাক-৭১ টেলিভিশন’ যৌথভাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “টাকা ছাপানো নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ভয় হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। এবং তারা বুঝতে পারছে না ঠিক কত টাকা ছাপাতে হবে। এটা এত ভাবার সময় নয়। এখন নানা মেকানিজম/ প্রাযুক্তিক প্লাটফর্মের মাধ্যমে সহজেই টাকা পাঠানো যায়। এতে যদি কিছু অপচয়ও হয়, সেদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।”
করোনায় আক্রান্ত মানুষদের খুঁজে বের করতে প্রচুর পরীক্ষার প্রয়োজন। সেদিক দিয়ে বিশ্বে পেছনের সারিতে বাংলাদেশ। সময়ের সাথে সাথে সরকার পরীক্ষা বাড়িয়েছে। দুঃশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, সংক্রমণ এবং সংক্রমিতের সংখ্যাও বাড়ছে। এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে সুস্থ হবার হার কম। যে কারণে সরকার পঞ্চমবারের মতো লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়েছে। কিন্তু মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। এরপরও লকডাউন মানুষ যতটুকু মানছে তার সুফল পাচ্ছে দেশ।
দেশে করোনায় আক্রান্ত প্রথম রোগী পাবার ৫০ দিন পেরিয়েছে। সংক্রমণ এই সময়ে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর কথা। যদিও ব্যাপকমাত্রায় পরীক্ষার অভাবে, দেশে করোনার সংক্রমন ঠিক কোন পর্যায়ে তা বোঝা যাচ্ছে না। তাই পরীক্ষার সংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় বাড়াতে হবে। দিনে ন্যূনতম ১০/১৫ হাজার পরীক্ষা হলেও, হয়তো দেশের করোনা পরিস্থিতির একটা চিত্র পাওয়া যাবে।
মানুষ লকডাউন মানতে চাইছে না বলে, অনেকেই ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্ব হাজির করছেন। কিন্তু এতে হাসপাতালগুলোর ওপরে যে চাপ তৈরি হবে তা সামলানোর ক্ষমতা কি বাংলাদেশের আছে? এখনই হাসপাতালগুলোর যে অবস্থা, তাতে রোগীর সংখ্যা কয়েক হাজার বা লাখ হলে কী হবে? কল্পনা করতেও ভয় হয়। অবশ্য ডিনায়াল মোডে (ভালো অবস্থানে আছি) থাকলে ভিন্ন আলোচনা।
এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার দুটোই সরকারের জন্য অতীব জরুরি। এবং জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অর্থনীতিতে ফিরতে হবে। সেক্ষেত্রে সবার আগে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে জিততেই হবে বা করোনাকে বাগে আনতে হবে। এটা ঠিক লকডাউনে অর্থনৈতিক ক্ষতি অপূরণীয়। কিন্তু করোনা পুনরায় ফিরে এলে এবং লকডাউনের প্রয়োজন হলে, তখনকার ক্ষতি হবে বর্তমানের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এই বাস্তবতায়, বেশি বেশি পরীক্ষা, বিচ্ছিন্নকরণ এবং করোনার সাথে সহাবস্থানই নেওয়াটাই শ্রেষ্ঠ কৌশল হবে। ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে এলেই কেবল ধীরে ধীরে আর্থিকখাতের দরজাগুলো খোলা যেতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে লকডাউন আরো কিছুদিন চালানো উচিত। এতে গরিবের কষ্ট বাড়বে। মানুষ অস্থির হবে। এবং সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। ঈদে ব্যবসা হবে না। হাহাকার বাড়বে। বিনিময়ে করোনার ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে পারলে অনেক জীবন রক্ষা হবে। দেশ লাভবান হবে। মানুষ বাঁচলে, আবার ঈদ আসবে। ব্যবসা করা যাবে। এবং দিনরাত খেটে আর্থিক ক্ষতিও কাটিয়ে ওঠা যাবে। কোনো কারণে অ্যামেরিকা-ইতালির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, আফসোসের সীমা থাকবে না।