নূরজাহানের মলিন মুখ। ভর দুপুরে লঞ্চের মাস্তুলের গা ঘেঁসে বসেছিলেন। খুলনাগামী লঞ্চ। নোঙর করে আছে কপোতাক্ষের তীরে কুড়িকাহুনিয়া টার্মিনালে। লঞ্চ ছাড়তে অনেক দেরি। তবুও আগেভাগেই নিচতলায় একটুখানি জায়গা নিয়েছেন নূরজাহান। সঙ্গে রয়েছেন তার দৃষ্টি প্রতিবন্ধি স্বামী নওশের আলী সরদার। মেয়ে কারিমা খাতুন আসবে আরও কিছুটা পরে। পরিবারটির শেষ যাত্রা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রলয় তাদের শেষটুকু নিয়ে গেল। অবশেষে নূরজাহানসহ তার পরিবারের সব সদস্যকে বিদায় জানালো কুড়িকাহুনিয়া।
পশ্চিম উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার একটি স্টেশন কুড়িকাহুনিয়া। প্রতাপনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এই স্টেশনের কাছেই ছিল নূরজাহানের ছোট্ট ভিটে। কিছু জমি নিজের ছিল; আর কিছুটা ছিল ধার করা। সেখানেই নড়বড়ে এক ঘরে থাকতেন এই পরিবারটি। প্রতিবন্ধি হলেও নওশের আলী সরদার চেয়েচিন্তে কিছু অর্থ পেতেন। আর নূরজাহান কাজ করতেন মজুরের। এ দিয়ে চলতো সংসার। টানাটানির এই সংসারেও একমাত্র মেয়ে কারিমা খাতুনকে লেখাপড়া করাতে ভুলেনি পরিবারটি। বাবার ইচ্ছেয় কষ্ট হলেও লেখাপড়া চালিয়ে গেছে সে। এবার এসএসসি পরিক্ষায় তার এ-প্লাস রেজাল্টে হতবাক এলাকাবাসী। নওশের আলী তার মেয়েকে আরও পড়াতে চান। মেয়ের বিয়ের চিন্তাও আছে তার মাথায়। কিন্তু কিনারা খুঁজে পান না। এরইমধ্যে ২০ মে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পান এদের শেষটুকু নিয়ে গেল। ফলে এই এলাকায় তাদের পক্ষে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। পাড়ি জমাচ্ছেন অন্যত্র। সে কারণেই সবকিছু নিয়ে লঞ্চে যাত্রা।
নূরজাহানের পথে আরও কয়েকজনকে দেখা গেল কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাটে। তারা লঞ্চে উঠেননি বটে; কিন্তু ঘর সংসার নিয়ে ইতিমধ্যে লঞ্চ টার্মিনালে উঠে গেছেন। দেখা হলো সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে। স্বামী আবুল কালাম ঢালী। বসত ঘর পানির তলায় ডুবে থাকায় আম্পানের রেখে যাওয়া অবশিষ্ট মালামাল নিয়ে উঠেছেন টার্মিনালের পুরুষ কক্ষে। যেখানে লঞ্চের যাত্রীদের বিশ্রামের স্থান; সেখানেই এখন সুফিয়ার ঘরগেরস্থালি। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সিগন্যাল শুনে রাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বদরুল ঢালীর বাড়িতে। সকালে বাড়িতে গিয়ে দেখেন কিছুই নেই। ঠিক কুলসুম বিবির অবস্থাও একই রকম। উঠেছেন লঞ্চ টার্মিনালের মহিলা কেবিনে। স্বামী বাবর আলী যাত্রীবেঞ্চিতে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। আর কুলসুম রান্না করছিলেন ইট দিয়ে বানানো চুলোয়। কবে এরা বাড়িতে ফিরতে পারবেন; জানেননা।
জলবায়ু উদ্বাস্তু কিংবা পরিবেশ উদ্বাস্তু অনেক মানুষের গল্প আমরা জানি। নূরজাহানের গল্পটা শুনতে শুনতে সে কথাগুলোই কানে বাজছিল। কীভাবে মানুষজন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলে যায়। ঠিক এভাবেই; নূরজাহানের মত। শেষ অবলম্বনটুকু হারিয়ে যাওয়ার পর আর কোন বিকল্প না থাকায় জীবিকা ও আবাসনের খোঁজে তারা ছুটে চলেন। খুলনা, নাকি অন্য কোথাও? নূরজাহান ঠিক বলতে পারলেন না কোথায় তাদের গন্তব্য। আলাপ হলো নওশের আলীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, এখানে কিছুই নেই। তাই দাকোপের জয়নগর যাচ্ছেন বাপদাদার ভিটের সন্ধানে। সেখানে বাড়িঘর ছিল বলে জানেন; গিয়ে খুঁজে বের করতে পারলে সেখানেই মাথা গুঁজবেন। কিন্তু আবাসনের চিন্তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মেয়ে কারিমা খাতুনের লেখাপড়া এবং বিয়ে। তার আর্তি, কষ্ট করে তো মেয়েকে এই পর্যন্ত পড়ালাম। এরপর কীভাবে এগিয়ে নিব সামনের পথ।
গত কয়েক বছরে নূরজাহানের মতো আরও বহু মানুষকে বিদায় জানিয়েছে গোটা প্রতাপনগর। ২০০৯ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে গোটা প্রতাপনগর এলাকা থেকে অন্তত ৩০০ পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। ইউনিয়ন বেষ্টিত কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্ট নাজুক থাকার কারণে স্বাভাবিক জোয়ারেও ইউনিয়নের অনেক স্থান প্লাবিত হয়। ফলে মানুষের আবাসন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চরম সংকট দেখা দেয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ইউনিয়নের ৫টি এলাকা ভাঙন ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এরমধ্যে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের হরিশখালী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন পয়েন্ট হয়ে উঠেছে। এখানে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পুরানো বেড়িবাঁধ অনেক আগেই ভেঙে গেছে। ঝুঁকি মোকাবেলায় এর ভেতর দিয়ে আরেকটি বাঁধ দিয়েছিল স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু সে বাঁধ আম্পানের পানির চাপে ভেঙে যায়। এখান থেকে যে পানি প্রবেশ করে তা গোটা প্রতাপনগর ছাড়াও আনুলিয়া, খাজরা ও বড়দল ইউনিয়নের অনেক এলাকায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়াও প্রতাপনগরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কুড়িকাহুনিয়া, শ্রীপুর, ১ নম্বর ওয়ার্ডের চাকলা চুইবাড়ি, ২ নম্বর ওয়ার্ডের সুভদ্রকাঠি এবং ৬নম্বর ওয়ার্ডের হিজলকোলা ঝুঁকিতে থাকে সারা বছর। গোটা ইউনিয়নে প্রায় ৮ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ।
সরেজমিনে দেখা যায়, এলাকায় মাইকের ঘোষণা অনুযায়ী বহু মানুষ ছুটেছেন বাঁধ মেরামতে। কেউ হরিশখালী, কেউবা কুড়িকাহুনিয়া। বাঁধ নির্মাণ কাজে এলাকার মানুষের বন্ধন বেশ দৃঢ়। জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ছাত্র, মজুর বলে কোন কথা নেই। ডাক পেলে সকলেই বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। নদীতে ভাটার টান শুরু হতে না হতে সে দৃশ্যই চোখে পড়ল হরিশখালীতে। দলে দলে মানুষজন নেমে পড়েছেন কাজে। কেউ বাঁশ পুঁতছেন, কেউ মাটির ওপরে খর বিছাচ্ছে। মানুষগুলো লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে মাটির চাকা এনে ফেলছেন বাঁধে। কেউ বাদ নেই। বড়দের সঙ্গে এসেছে শিশুরাও। হরিশখালী যে মানুষগুলো বাঁধ মেরামতে যাচ্ছিলেন; এদের মধ্যে দেখা মিলল কয়েকজন শিশুর। আউয়াল (১২), আল মামুন (১৪), সজীব হোসেন (১৪), রণি সরদার (৮) এবং ওসমান গনি (৮)। ওরা সকলেই বেশ কয়েকদিন ধরে বাঁধ মেরামতের কাজে যাচ্ছে।
বাঁধ মেরামতের বিষয়টি কীভাবে সমন্বয় হয়? জানতে চেয়েছিলাম বাঁধ মেরামতের কাজে নেতৃত্বদানকারী যুবক মাহমুদুল হাসান মিলনের কাছে। তিনি বলেন, বাঁধ মেরামতে সরকার থেকে খুব বেশি সহায়তা মিলে না। স্থানীয় প্রয়োজনে স্থানীয় মানুষদেরকেই এ কাজ করতে হয়। ঘের মালিকসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের চাঁদার টাকায় অধিকাংশ বাঁধ মেরামত হয়। সহায়তা নিয়ে সকলেই এগিয়ে আসে। মানুষজন স্বত:স্ফুর্তভাবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বছর জুড়ে এই কাজগুলো অব্যাহত না রাখলে প্রতাপনগর ইউনিয়নে আরও বেশি সমস্যা হতো। মাহমুদুল হাসানের এই কথারই প্রমাণ মিলে হরিশখালী গিয়ে। আশাশুনির এপিএস ডিগ্রি কলেজের শাহজাহান হোসেন নিজেই বাঁধ মেরামত কাজে উপস্থিত। তিনিও রয়েছেন নেতৃত্ব পর্যায়ে। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে আমরা এ কাজ করছি। আমাদের কাজ আমাদেরই করতে হবে।
বেড়িবাঁধের এই বিপন্নতায় এলাকায় বহুমূখী সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলেন, সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবন জীবিকা ও আবাসনে। যারা চিংড়ির ঘের করে জীবিকা নির্বাহ করছে, তাদের অবস্থা শোচনীয়। বার বার পানি প্রবেশ করে লাখ লাখ টাকা লোকসান দিচ্ছে। জলাবদ্ধতার কারণে বহু মানুষের আবাসন তছতছ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা অন্যত্র যেতে বাধ্য হচ্ছে। স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। বেড়ে চলেছে সুপেয় পানির সংকট। অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে এলাকার চলাচল বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। শেষ বেলায় কয়েকজন বয়সী মানুষের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল তালতলা বাজারের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডা. আবদুল আজিজের চেম্বারে। এদের একজন ফজর আলী গাজী (৭৩), তার কথায় যোগ করছিলেন অন্যান্যরা। তারা বলছিলেন, ষাটের দশকে এই এলাকায় বাঁধ নির্মাণের পর আমরা বেশ ভালোই ছিলাম। কিন্তু যুগের পর যুগ এই বাঁধে কোন মাটি পড়েনি। টিকবে কীভাবে? এলাকার মানুষের দাবি একটা শক্ত টেকসই বেড়িবাঁধ।
প্রতাপনগরের যেদিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি। ডুবে আছে বহু বাড়িঘর। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে হয় নৌকায়; না হয় সাঁতরে। আম্পানের পরের দিনগুলো চলছে এভাবেই। তালতলা বাজার থেকে হরিশপুর বাঁধ পর্যন্ত যেতে আমাদের ভরসা ছিল নৌকা। ক্ষেতের আইলের ওপর দিয়ে, কারো বাড়ির সামনের উঠোন পেরিয়ে, কারো সবজি ক্ষেতের ওপর দিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছাই হরিশপুরের বাঁধে। মানুষজনের দুর্ভোগের শেষ নেই। এরপরও এদের খোঁজ নিতে কেউ এলো না।