'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না', বলে ঘোষণা করেছিলেন এক কবি। উদ্ধৃতিটি বহুল প্রচারিত ও উচ্চারিত হলেও সেটি কার, তা অনেকেই জানেন না। তিনি ভারতীয় কবি নবারুণ ভট্টাচার্য।
যদিও উক্তিটি করা হয়েছে ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে ও রাজনৈতিক কারণে, তথাপি চলমান করোনাকালের (কোভিড-১৯) প্রচণ্ড তাণ্ডবে উক্তিটি প্রাসঙ্গিক। কারণ, করোনায় বিশেষ কোনো দেশ নয়, সমগ্র বিশ্বই এখন এক জাজ্বল্যমান মৃত্যু উপত্যকা।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনে উহানে উদ্ভূত অচেনা, অজানা, মারাত্মক করোনাভাইরাসটি বৈশ্বিক মহামারি আকারে ব্যাপ্তির ছয় মাসের সময়কালে পৃথিবীতে এক কোটি ৮৬ হাজারের বেশি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
বিশ্বখ্যাত জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী, করোনা প্রকোপের ছয় মাসে প্রাণ ঝরেছে ৫ লাখ ১ হাজার ৩৯৩ জনের। সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন সাড়ে ৫৪ লাখ ৫৮ জন।
এদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। তার ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা ১৭৩৮ জন। মোট শনাক্তের সংখ্যা এক লাখ ৩৭ হাজার ৭৮৭ জন।
উৎপত্তিস্থল চীন হলেও করোনায় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে ১ লাখ ২৮ হাজার ১৫২ জন করোনায় মারা গেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫৩৭ জন, সুস্থ হয়েছেন ১০ লাখ ৮১ হাজার ৪৩৭ জন।
কোভিড-১৯ আক্রান্তের পরিসংখ্যানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল, সেখানে ১৩ লাখ ১৫ হাজার ৯৪১ জন আক্রান্ত এবং ৫৭ হাজার ১০৩ জন মৃত। পরের স্থানে নাম এসেছে রাশিয়ার। রাশিয়ায় মোট আক্রান্ত ৬ লাখ ২৭ হাজার ৬৪৬ জন এবং ৮ হাজার ৯৬৯ জন মারা গেছেন।
আরো যেসব দেশ করোনায় প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও পরিস্থিতি কিছুটা সামলে উঠেছে, তার মধ্যে ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স অন্যতম। চীনও করোনার প্রকোপ অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। তবে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেও দেশগুলো পুরোপুরি করোনামুক্ত হচ্ছে না। এমনকি নিয়ন্ত্রণে আসা উৎপত্তিস্থল চীনে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ দেখা দিয়েছে।
ক্রমবর্ধমান আক্রান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উপরের দিকে চলে আসছে। কারণ স্বল্পোন্নত এসব দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে।
ভারতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৫ লাখ ২৯ হাজার ৫৭৭ জন এবং ১৬ হাজার ১০৩ জন মারা গেছে। পাকিস্তানে ২ লাখ ২ হাজার ৯৫৫ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ৪ হাজার ১১৮ জন।
চীনের উহান শহরে গত বছর ডিসেম্বর থেকে দেখা যাওয়া এই নতুন ভাইরাস মূলত ফুসফুসে বড় ধরনের সংক্রমণ ঘটায়। জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষ্মণ। নতুন ভাইরাসটির জেনেটিক কোড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এটি অনেকটাই সার্স ভাইরাসের মতো হলেও প্রতিকারহীন ও অতি মারাত্মক, যা সমগ্র বিশ্বকে পরিণত করেছে মৃত্যু উপত্যকায়।
ধারাবাহিক মৃত্যু ও আক্রান্ত বৃদ্ধির কারণ হলো, এ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষক, বিজ্ঞানীরা অবিরাম কাজ করছেন প্রতিষেধকের জন্য। ভ্যাকসিন সংক্রান্ত আশাবাদের অনেক তথ্যই আসছে এই ঘোরতর সঙ্কুল পরিস্থিতিতে।
ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক না-থাকলেও হাজার-হাজার চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী লড়ছেন অদৃশ্য করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে। অনেকেই লড়তে লড়তে ভাইরাসে প্রাণ দিয়েছেন। এই তালিকায় চিকিৎসক ছাড়াও পুলিশ, সরকারি কর্মচারি ও বিভিন্ন পেশার মানুষও আছেন। যারা মৃত্যু উপত্যকায় জীবনের গান গেয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন।
৮০০ কোটির বেশি জনসংখ্যার বিশ্বে ছয় মাসে এক কোটি লোকের আক্রান্ত ও পাঁচ লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হওয়ার ঘটনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এরচেয়ে বেশি লোক বছরে আক্রান্ত ও মারা যায় অন্যান্য রোগে, দুর্ঘটনায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে, যুদ্ধ-গৃহযুদ্ধ-সংঘাতে। এসব ক্ষয়ক্ষতি স্বাভাবিক ও দৃষ্টিগ্রাহ্য মনে হয়। কিন্তু করোনায় মানব ক্ষতি অনেক বড় আকারে সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। কারণ, এসব মৃত্যু একতরফা ভাবে করোনা নামক অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে। যা মানবজাতিকে ভাবায়, উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত করে।
মানবজাতি সভ্যতার লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাসে কখনোই একতরফা আক্রান্ত হতে অভ্যস্থ নয়। লড়াকু মানুষ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এগিয়ে এনেছে সভ্যতার চাকা। দুর্যোগ, মারী, দুর্বিপাককে পরাজিত করেই মানুষ বাসযোগ্য করেছে সবুজ পৃথিবীকে। এই পৃথিবীকে করোনার কারণে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হতে দিতে পারেনা মানুষ।
ফলে ভ্যাকসিক আবিষ্কারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি চলছে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি পালনের মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধের তৎপরতা। চলছে জীবনবাজি রেখে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের লড়াই। কোটি মানুষ আক্রান্ত ও লক্ষ মানুষের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে পৃথিবী যতই মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হোক, সেখানে করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে জীবনের গানই শোনা যাচ্ছে। আক্রান্ত বা মৃত্যুর ভয়াবহ পরিসংখ্যান ছাপিয়ে সংগ্রামী মানুষের প্রদীপ্ত প্রাণময়তার আলোকিত প্রতিচ্ছবিই দৃশ্যমান হচ্ছে পৃথিবী দেশে দেশে, সর্বত্র।