প্রতি মাসে বিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা এবং এশীয় প্রতিবেশীদের সাথে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে রাখছে নতুন চমক।মাত্র তিন মাসেই আফগান মুদ্রাকে বিশ্বব্যাপর্রয শীর্ষে নিয়ে গেছে দেশটি। বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবাধিকার পরিস্থিতির মধ্যে একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশের জন্য এটি একটি অসাধারণ সাফল্য।
ক্ষমতাসীন তালেবান দুই বছর ধরে আফগানীদের একটি শক্ত অর্থনীতি কাঠামোর জন্য একাধিক ব্যবস্থা চালু করেছে। যার মধ্যে স্থানীয় লেনদেনে ডলার এবং পাকিস্তানি রুপি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং দেশের বাইরে গ্রিনব্যাক আনার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ছিল উল্লেখযোগ্য।
একটি অনলাইন ট্রেডিংকে অবৈধ করাসহ যারা নিয়ম লঙ্ঘন করবে তাদের কারাদণ্ডের হুমকি ঘোষণা করেছে দেশটি। মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ, নগদ প্রবাহ এবং অন্যান্য রেমিটেন্স এই ত্রৈমাসিকে আফগানীদের প্রায় ৯ শতাংশে উঠতে সাহায্য করেছে, কলম্বিয়ান পেসোর ৩ শতাংশ লাভের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছরে লেনদেন প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে।কলম্বিয়া এবং শ্রীলঙ্কার মুদ্রার অবস্থানকে পিছনে ফেলে বৈশ্বিক তালিকায় তৃতীয় স্থানে পৌঁছেছে আফগানিস্তান।
বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেকারত্ব প্রবল দেশটিতে দুই-তৃতীয়াংশ পরিবার তাদের মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে সংগ্রাম করে। মুদ্রাস্ফীতির সংকট দেশটিতে ভঙ্গুর অর্থনীতি তৈরি করেছিলো।তাই ২০২১ সালের শেষ থেকে কমপক্ষে ১৮ মাস ধরে জাতিসংঘ থেকে দরিদ্রদের সহায়তার জন্য মার্কিন ডলারের সাপ্তাহিক প্লেনলোড এসেছে্। যার মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত প্রদানের রেকর্ড রয়েছে যা আফগানিস্তানের মন্দা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক ছিল।
তবে, ওয়াশিংটন-ভিত্তিক নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কামরান বোখারি মুদ্রার এই অস্থিতিশীল উত্থানকে স্বল্পমেয়াদী ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, আফগানিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রা এখন মূলত মানি চেঞ্জারদের মাধ্যমে লেনদেন করা হয় যারা স্থানীয়ভাবে সররাফ নামে পরিচিত। এরা বাজারে স্টল রাখে বা শহর ও গ্রামে দোকান থেকে কাজ করে। কাবুলের জমজমাট, খোলা-বাতাস বাজার সারাই শাহজাদা হল দেশের ডি-ফ্যাক্টো আর্থিক কেন্দ্র, যেখানে প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য অর্থের লেনদেন ঘটে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, আফগানিস্তানে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কারণে, প্রায় সমস্ত রেমিট্যান্স এখন প্রাচীন হাওয়ালা অর্থ স্থানান্তর পদ্ধতির মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসার একটি মূল অংশ হিসেবে এ পদ্ধতি প্রচলিত আছে।
জাতিসংঘ অনুমান করেছে, আফগানিস্তানে এই বছর প্রায় ৩.২ বিলিয়ন ডলারের সাহায্যের প্রয়োজন। বিশ্ব সংস্থার আর্থিক ট্র্যাকিং পরিষেবা অনুসারে এই পর্যন্ত প্রায় ১.১ বিলিয়ন ডলার মোতায়েন করা হয়েছে। গত বছর, আফগানিস্তানের ৪১ মিলিয়ন মানুষের অর্ধেক জীবন-হুমকিপূর্ণ ক্ষুধার সম্মুখীন হওয়ায় সংস্থাটি প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের তহবিল প্রবাহ ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে জাতিসংঘ আফগানিস্তানে প্রায় ৫.৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য ও উন্নয়নে নিয়োজিত করেছে।
বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে যে এই বছর দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হওয়া বন্ধ হবে।২০২৫ সাল পর্যন্ত ২ থেকে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করে।
লন্ডনে বিএমআই-এর ইউরোপ কান্ট্রি রিস্কের প্রধান আন্বিতা বসু বলেন. বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আফগানদের চাহিদা বাড়িয়ে তুলছে।এরপরেও চলতি বছরের শেষের দিকে আফগান সরকার স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
একটি শক্তিশালী মুদ্রাব্যবস্থা আফগানিস্তানের আমদানির জন্য মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে।বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল যার দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি।তালেবান প্রশাসন খনিজ সম্পদ লিথিয়াম সহ বিভিন্ন সমৃদ্ধ সম্পদে বিনিয়োগ চাইছে, যার মূল্য প্রায় ৩ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বড় আকারের লোহা, আকরিক এবং সোনার খনি নির্মাণের জন্য এই মাসে দেওয়া ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে চীনা, ব্রিটিশ এবং তুর্কি কোম্পানি জড়িত ছিল। তালেবানও জানুয়ারিতে তেল উত্তোলনের জন্য একটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে।
চলতি বছরের মে মাসে চীন ও পাকিস্তান আফগানিস্তানে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সম্প্রসারিত করতে সম্মত হয়েছে।দেশটির সম্ভাব্য অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবনা রয়েছে।গত সোমবার(২৫ সেপ্টেম্বর) আফগানিস্তান প্রায় ৭৮.৫০ ডলার প্রতি লেনদেন করেছে।
মুখপাত্র হাসিবুল্লাহ নুরি বলেছেন, দা আফগানিস্তান ব্যাংক, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, মুদ্রা সমর্থন করার জন্য প্রায় প্রতি সপ্তাহে ১৬ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত মুদ্রা নিলাম করছে।আফগানিস্তানের মুদ্রা আগের পর্যায়ে ফিরে এসেছে। মুদ্রার ওপর চাপ কম হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসার জন্য প্রতি মাসে ডলার তোলার সীমা ২৫০০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০০০ ডলার করেছে এবং ব্যক্তিদের জন্য সপ্তাহে ৬০০ করেছে যা দুই বছর আগে ২০০ ডলার ছিল।
তবে, জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, যদি দেশটিতে এই বছর বৈদেশিক সাহায্য ৩০ শতাংশ হ্রাস পায়, তবে এটি মাথাপিছু আয় ৩০৬ ডলারে নেমে আসবে, যা ২০২০ সাল থেকে ৪০ শতাংশ হ্রাস পাবে।