শক্তি, ক্ষমতা, রূপ আর অহংকার চিরস্থায়ী নয়। এই কথাই যেন সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে আফগানিস্তানের সেনা সদস্যদের বেলায়। অস্ত্র হাতে যাদের দেখে ভয়ে থাকতো জনসাধারণ। আজ তাদের হাতে খুর-কাঁচি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন বছর আগে তালেবানের হাত থেকে বাঁচতে সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে আফগান সেনা সদস্যদের অনেকে। তাদেরই একজন ২৯ বছর বয়সী জাকি মারজাই। তিনি ভারতের নয়াদিল্লিতে এখন নাপিতের কাজ করেন।
মারজাই আফগানিস্তানের সেনাবাহিনীর এলিট স্পেশাল ফোর্সের একজন সৈনিক ছিলেন। তিনি ২০১৫ সালে সার্জেন্ট হিসেবে আফগান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং কমিশন্ড অফিসার হওয়ার পথে ছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালের ২০ জুন তার সবকিছু বদলে দেয়। আফগানিস্তান তালেবানের হাতে চলে যাওয়ার পর তার মতো অনেকের জীবনও রাতারাতি পাল্টে গেছে।
জাকি মারজাই বলেন, ২০১৮ সালের ২০ জুন দুপুর ২টার দিকে আফগানিস্তানের গজনি প্রদেশের একটি ক্যাম্পের বাইরে আমিসহ আরও কয়েকজন বাইরে অবস্থান করছিলাম। আক্রমণটি এতটাই তীব্র ছিল যে আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই ২৫ জন সেনা তালেবানের বুলেটের আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় এবং ছয়জন আহত হয়েছিল। আমার (মারজাই) চিবুক এবং ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তালেবানরা পুরো ক্যাম্প নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।
ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস জানায়, আফগানিস্তানে দুই দশকের যুদ্ধে আনুমানিক ৭০ হাজার আফগান সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন।
মারজাই জানান, তাকে প্রথমে গজনির নিকটবর্তী একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য কাবুলের একটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
প্রায় এক বছর চিকিৎসার পরও চোয়াল ঠিক না হওয়ায় আফগান সরকার তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠায়। আফগানিস্তানে তার মা-বাবা, এক বোন ও সাত ভাই রয়েছে।
প্রায় দুই দশক পর ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় তালেবান। মারজাই বলেন, তালেবানরা যেদিন দেশ দখল করে তখন আমি সারা রাত কেঁদেছিলাম। আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম চিকিৎসা শেষে পরিবারের কাছে ফিরে যাবো এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দিব। কিন্তু এখন আমি এখানে (ভারত) আটকে আছি।
তিনি বলেন, ক্ষমতা দখলের পর আফগান প্রশাসনের বিভিন্ন পদে কর্মরত অথবা অতীতে পশ্চিমাদের পক্ষে কাজ করা সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তালেবান। কিন্তু আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশন জানিয়েছে, তালেবান সরকার কমপক্ষে ২০০ জন সাবেক সেনা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। তাই তিনি ভয়ে আর আফগানিস্তানে ফিরে যাননি। বেঁচে থাকতে তিনি এখন নাপিতের কাজ করছেন।
মারজাই ভারতে একমাত্র আফগান সৈনিক নন, তার মতো এমন আরও অনেকে দেশে ফিরতে পারেননি।
২৭ বছর বয়সী খলিল শামাস তাদেরই একজন । যিনি আফগানিস্তানের সাবেক লেফটেন্যান্ট। তিনি এখন নয়াদিল্লির একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটার হিসাবে কাজ করেন।
তবে কয়েকজন সেনা সদস্য আফগানিস্তানেও ফিরেছেন। অনেকে আবার ইরান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পাড়ি দিয়েছেন বলে জানান মারজাই।
২০২১ সাল থেকে দূতাবাস থেকে কোনো সাহায্য পান না জানিয়ে মারজাই বলেন, নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য আমাদের নিজেদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মারজাই একটি ছয় মাসের চুল কাটার কোর্স করেন এবং একটি সেলুনে কাজ শুরু করেন।
তিনি দক্ষিণ দিল্লির জনাকীর্ণ ভোগল এলাকায় আরও তিনজন আফগানের সঙ্গে স্যাঁতসেঁতে গন্ধযুক্ত একটি দুই কক্ষের অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। তিনি আরও বলেন, সরকারের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা ছাড়া বিদেশের মাটিতে বসবাস করা চ্যালেঞ্জিং। কারণ আমাকে শুধু নিজের দেখাশোনাই করতে হয়নি, পরিবারের জন্যও টাকা পাঠাতে হয়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদন বলা হয়, ভারতে ১৫ হাজারের বেশি আফগান শরণার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার আফগান তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২১ সাল থেকে প্রায় ১৬ লাখ আফগান দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।