রাশিয়াকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে ভূমিধস জয় পেয়ে পঞ্চম দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু সপ্তাহ না পেরুতেই গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হামলার শিকার হয়েছে মস্কো।
গত শুক্রবার (২২ মার্চ) সন্ধ্যায় মস্কোর উত্তরে ক্রাসনোগোর্স্ক অঞ্চলে ক্রোকাস সিটি হলে শত শত মানুষ কনসার্ট দেখতে জড়ো হয়েছিলেন। গান শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে সশস্ত্র ব্যক্তিরা থিয়েটারে ঢুকে পড়ে। তারা নির্বিচার গুলি ছুড়তে শুরু করে। ভয়াবহ এই হামলায় ১৩৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দেড় শতাধিক।
এদিকে, ভয়াবহ এই হামলার দায় আইএস নিলেও হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ও পরিচয় জানা যায়নি। উগ্রবাদীরা এর আগে রাশিয়ার বিচ্ছিন্ন অঞ্চলকে সমর্থন করার জন্য হামলা চালিয়েছে। তবে পুতিন হামলার পেছনে ইউক্রেনের যুক্ত থাকার ইঙ্গিত দিলেও কোন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।
রুশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ ঘটনায় চার বন্দুকধারীসহ ১১ জনকে আটক করা হয়েছে। সন্দেহভাজন চারজনকে ইউক্রেন সীমান্তের কাছ থেকে গ্রেফতার করা হয়।
পুতিন অভিযোগ করেছেন, ওই চারজন ইউক্রেনে পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে এই হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে কিয়েভ। কিয়েভের কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে বলেছে, ইউক্রেনে হামলা বাড়াতে একে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে মস্কো। এদিকে আরও সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় রাশিয়াজুড়ে প্রধান পরিবহনকেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পাবলিক কনসার্ট এবং ক্রীড়া অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতির পর স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা, যে উদ্দেশ্যে পুতিনকে রাশিয়ানরা ভোট দিয়েছিলেন তা ব্যর্থ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার যে আশায় রুশ নাগরিকেরা ভোট দিয়ে পুতিনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন, তার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। দীর্ঘদিন ধরেই পুতিনকে বিশাল ও অশান্ত দেশটিকে শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম একজন নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পুতিনের গত ২৪ বছরের শাসনামলের মধ্যে এখন রাশিয়াকে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ ও অস্থির মনে হচ্ছে।
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের তৃতীয় বছর চলছে। যার চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে রাশিয়ানদের। সামরিক বাহিনী হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ না করলেও মার্কিন তথ্য বলেছে, আনুমানিক ৩ লাখের বেশি রাশিয়ান হতাহত হয়েছেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, গত বছর যেসব সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে, তাদের এখনো ইউক্রেন থেকে ফিরিয়ে আনা হয়নি। উদ্বেগে থাকা স্বজনেরা এ নিয়ে ইতোমধ্যে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ শুরু করেছেন। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় রুশ নাগরিকদের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধে পাঠানোর জন্য সেনা সমাবেশের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এদিকে, ক্রেমলিনের বিরোধিতাকারী ইউক্রেনভিত্তিক রুশ জঙ্গিগোষ্ঠী ইউক্রেনীয় ড্রোন ও সীমান্ত হামলা অব্যাহত রেখেছে। ইউক্রেনীয় ফ্রন্টে রুশ কমান্ডারদের দুর্বল কর্মক্ষমতা ও অস্ত্র সম্পূর্ণরূপে অপ্রত্যাশিত পরিবেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এতে সামরিক ব্লগার ও সামরিক কট্টরপন্থীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ভিন্নমত দেখা দিচ্ছে।
রাশিয়ান হাইকমান্ডের বরখাস্তের দাবিকারী ওয়াগনার ভাড়াটে গোষ্ঠীর নেতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের গত বছর বিদ্রোহ ছিল ক্রেমলিন কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ। প্রিগোজিনের রহস্যজনক মৃত্যুতে অবশ্য সে হুমকি চিরতরে দূর হলেও অন্য অসন্তুষ্ট কট্টরপন্থীদের আবির্ভাব দেখা গেছে।
একইভাবে, রাশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা আলেক্সি নাভালনির মৃত্যু, ক্রেমলিনের সমালোচনা চিরতরে চুপ করে দিয়েছে। কিন্তু মস্কোতে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়
যোগ দেওয়া তার হাজারও সমর্থক ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ দিন ‘মিডডে এগেইনস্ট পুতিন’ বিক্ষোভ আয়োজনকারীরা তাদের অসন্তোষের কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু এখন সবার ফোকাস চলে গেছে রাশিয়ার বড় ধরনের জঙ্গি হামলার পুনরুত্থানের দিকে। যার সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ বা ক্রেমলিনের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার কোনো সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মার্চের শুরুতেই এ ধরনের হামলার গোয়েন্দা বার্তায় সতর্ক করেছিল মস্কোকে। মার্কিন কর্মকর্তাদের দাবি, তারা কয়েক মাস ধরে রাশিয়াকে গোয়েন্দা তথ্য জানিয়ে আসছেন।
কিন্তু, পুতিন নির্বাচন সামনে থাকায় তা উপেক্ষা করেছেন। সতর্কতাগুলোকে ‘উসকানি... রুশ সমাজকে ভয় দেখানো ও অস্থিতিশীল করার’ অভিপ্রায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। কারণ কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের পর মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে রয়েছে বর্তমানে। এমতাবস্থায় পশ্চিমাদের সতর্কবার্তা আমলে না নেওয়াকেও স্বাভাবিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কিন্তু একজন নেতা যিনি রাশিয়ানদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা তিনি রক্ষা করতে পারেননি। তার জন্য ভয়াবহ এই হামলা বড় ধরনের ধাক্কা বটে।