ভারতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে শালীনতা বজায় থাকুক, বিশেষত ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে, সেই আর্জি জানাতে এক অভিনব পন্থা নিয়েছেন কলকাতার বাসিন্দা ঝর্ণা ভট্টাচার্য।
সংবাদ মাধ্যম বিবিসি সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকের দপ্তরের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি এবং সমচিন্তাসম্পন্ন আরও কয়েকজন নাগরিক। প্ল্যাকার্ডে লেখা বার্তা স্পষ্ট ছিল, ‘নির্বাচনী প্রচারে অশালীন ভাষা বন্ধ করুন।’
পেশায় বাচিকশিল্পী এবং লেখিকা ঝর্ণা ভট্টাচার্য বলেন, আমরা সবাই চাই রাজনীতিতে শালীনতা বজায় থাকুক। ভোটে দৈহিক রক্তক্ষরণের পাশাপাশি মানসিক রক্তক্ষরণও বন্ধ হোক। সুস্থ স্বাভাবিক ভোট হোক।
ভোটের প্রচার-সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ভাষা প্রয়োগ রুচিসম্মত হোক, এই আর্জি নিয়ে তার অভিনব উদ্যোগ ‘সরস্বতীর ভাণ্ডার’।
ঝর্ণা ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভাষা কেন শালীন হবে না, এটাই তো প্রশ্ন। একজন নেতা অন্য নেতার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যে ভাষা প্রয়োগ করছেন, সেটা রুচিশীল হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। বিরোধীদের বিষয়ে সংযত থেকেও তো কথা বলা যায়।
রাজনীতিতে দুর্নীতির পাশাপাশি কুরুচিকর শব্দের ব্যবহার বেড়ে চলেছে বলে মনে করেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকারও। তিনি বলেন, নির্বাচন ভদ্র সমাজের আচার, অনুশীলন বলেই মনে করি। কিন্তু রাজনীতি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতি অবৈধ উপায়ে রোজগারের পথ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এবং অপরাধের এই পরিসরটা বেড়ে যাওয়ায় ভাষাগত অপরাধটাও বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, তাদের (নেতাদের) বাইরে একটা ভদ্রতার মুখোশ আছে কিন্তু হিপোক্রেসিও আছে। কারও মৃত্যু কামনা করা, চরিত্র হনন, কারও পরিচয় নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য রাজনীতিতে বেড়ে চলেছে। এটা কাম্য নয়।
তবে রাজনীতির প্রসঙ্গ এলেই কুরুচিকর ভাষার উল্লেখ আজ থেকে নয়। এই চল বহু যুগ আগে থেকে, এমনটাই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতিহাসবিদ এবং লেখক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী যেমন বলছেন, প্রাচীনকাল থেকেই রাজনীতির প্রসঙ্গ এলে খারাপ কথা বলার বিষয়টা আসেনি, এমনটা কিন্তু ছিল না। মহাভারতেও রাজনীতির বিষয়টা এলেই ভাষা অশালীন হয়ে উঠেছে।
যে ভাবনা থেকে ‘সরস্বতীর ভাণ্ডার’
দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ভাণ্ডারে সুচিন্তা এবং পরিশীলিত শব্দ আসুক, এই ভাবনা নিয়েই তৈরি হয়েছে 'সরস্বতীর ভাণ্ডার'। নামটা ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ থেকে অনুপ্রাণিত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে করা ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পের আওতায় রাজ্যের নারীরা আর্থিক সহায়তা পান।
‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প যদি আর্থিক নিশ্চয়তা দেয় তা হলে প্রতিনিধিত্বকারীদের শালীন এবং সংযত ভাষা ব্যবহার কেন নয়? তবে শুধু রাজনীতি নয়, অন্য অনেক ক্ষেত্রে ভাষা প্রয়োগ নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে’, বলেছেন ঝর্ণা ভট্টাচার্য।
মূলত রাজনীতির পরিসরে শালীনতাকে ফেরানোকে কেন্দ্র করেই এই উদ্যোগ। কিন্তু তার গভীরে রয়েছে আরও একটা কারণ।
ঝর্ণা ভট্টাচার্য বলেন, নতুন প্রজন্ম কাকে বেঁচে নেবে যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভাষাই পরিশীলিত না হয়? তারা তো ক্রমশ ভোটবিমুখী হয়ে উঠবে। শুধু তাই নয়, কেন নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে আসবে যদি না আমরা তাদের সেই পরিবেশটুকু দিতে পারি? আমরা ভাবি বাড়ির ছেলে মেয়েদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাব। কিন্তু সে রাজনীতিতে আসুক সেটা চাই কি?
বেশ কিছুদিন আগে, তার এক পরিচিত ব্যক্তি টিভিতে, খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে আসা নেতাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বাড়ির ছোটদের সামনে সেই খবর দেখা বা পড়া যায় না।
রাজনীতির ভাষা কি কখনও 'খেলা হবে' হতে পারে? আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে কী বার্তা দিতে চাইছি? সে কাকে নির্বাচন করবে, সেই প্রতিনিধির ভাষাই যদি রুচিশীল না হয়? মূলত সেই চিন্তা থেকেই সরস্বতীর ভাণ্ডার জানাচ্ছেন ওই শিল্পী।
তার সঙ্গে এই উদ্যোগে সামিল হয়েছেন অভিনেতা এবং চিত্রপরিচালক দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, নির্বাচনে ভাষা রুচিশীল হোক এই কথা বলতে যখন রাস্তায় নামতে হচ্ছে তার চাইতে হাস্যকর আর কী হতে পারে! নির্বাচন বা রাজনীতির ময়দান তো জনসেবার জন্য এমনটাই বলা হয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেন, জনসেবায় যদি কুরুচিকর ভাষা প্রয়োগ হয় তাহলে সেবককে নিয়ে দ্বিধা তো থাকেই। জনসেবা করতে চাইছেন কিন্তু একে অপরের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে যে ভাষা প্রয়োগ করছেন নেতারা, তাতে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর কীভাবে থাকে!।