ভারতের শিল্প জগতের অনন্য রত্ন টাটা গ্রুপের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান রতন টাটার শেষকৃত্যে দেখা গেল ভিন্ন ছবি। ভারতের জাতীয় পতাকায় মোড়ানো মৃতদেহ বহনকারী কাসকেটের সামনে পারসি, হিন্দু ও শিখ পুরোহিতের পাশাপাশি বৌদ্ধ ভিক্ষু, মুসলিম মৌলভী ও খ্রিস্টান যাজকের উপস্থিত। তারা নিজ নিজ ধর্মের আলোকে প্রার্থনা করছেন।
রতন টাটা ছিলেন পারসি ধর্মাবলম্বী। ব্যক্তিগত জীবনে তার সফলতা ও মানবিক চরিত্রের নানা কথা সামনে আসলেও তার ধর্মাচারের দৃশ্য খুব একটা সামনে আসেনি। রতন টাটার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সন্ধ্যায়। তার মরদেহ বৈদ্যুতিক চুল্লিতে দাহ করা হয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে।
রীতি অনুযায়ী পারসিদের মৃতদের খায় চিল-শকুনে
পারসি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার অন্যতম হলো- মৃতদেহ সৎকারের প্রক্রিয়া। তারা হিন্দুদের মতো মৃতদেহ দাহ করেন না, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মতো কবরও দেন না। পারসিদের মৃতদেহ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শেষে নিয়ে যাওয়া হয়- টাওয়ার অব সাইলেন্সে।
কলকাতার বেলেঘাটায় এমন একটি স্থাপত্য আছে, যাকে ডাখমা বলা হয়। এটাই জরথুস্ত্রীয় ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ পারসি সম্প্রদায়ের শেষকৃত্য স্থান। স্থাপনাটি একটু উঁচুস্থানে তৈরি গোল টাওয়ার বিশেষ। সেখানে মৃতদেহ খোলা আকাশের নিচে সূর্যের আলোয় রেখে আসা হয়। তারপর শকুন, চিল, কাক সেই মৃতদেহ ছিঁড়ে খুবলে খায়। মুম্বাইয়ের দুঙ্গারওয়াডিতে টাওয়ার অব সাইলেন্স রয়েছে।
পারসিরা মনে করেন, মৃতদেহ দাহ করলে বা কবর দিলে পরিবেশ দূষণ হয়। আসলে পারসিরা মৃতদেহকে অপবিত্র বলে মনে করেন। তাদের বিশ্বাস, মৃতদেহ দাহ করলে তাতে আগুন অপবিত্র হয়ে যায়, কবর দিলে মাটি অপবিত্র এবং নদীতে ভাসিয়ে দিলে পানি অপবিত্র হবে। পারসিদের কাছে আগুন, মাটি ও পানি অত্যন্ত পবিত্র। তাদের বিশ্বাস মৃতদেহ দাহ করা বা কবর দেওয়া ধর্মীয় বিচারে একেবারেই অনুচিত।
তবে বর্তমানে ভারতে শকুন উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যাওয়ায় সৎকার প্রক্রিয়ায় সমস্যায় পড়ছেন পারসিরা। শহরের দিকে আজকাল শকুন প্রায় দেখাই যায় না। শকুন মানুষের মাংস অত্যন্ত দ্রুত খেয়ে ফেলতে পারে। তাই আগে যেখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় একটা মৃতদেহ শেষ হয়ে যেত, সেখানে এখন তিন থেকে চার দিন লেগে যাচ্ছে এবং সেই মৃতদেহ থেকে পঁচা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।
শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এদেশে বসবাসকারী পারসিদের অনেকেই এখন মৃতদেহ সৎকারের করার জন্য দাহ করার প্রক্রিয়া বেছে নিচ্ছেন। বৈদ্যুতিক চুল্লিতে মৃতদেহ সৎকার করেছেন পারসি ধর্মের কেউ কেউ। এ প্রক্রিয়া রতন টাটার দেহ ওরলির শ্মশানে দাহ করা হয়েছে।
পারসিদের শেষকৃত্য
টাওয়ার অব সাইলেন্সে কিংবা শ্মশানে- যেখানে শেষকৃত্য হোক, শেষকৃত্যের আগে বিশেষ কিছু রীতি তারা পালন করেন। পারসি মতে, মৃতদেহ গোসল করিয়ে বিশেষ পোশাক পরানো হয়। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পারসি ধর্মের কিছু মানুষ। এরপর সাদা কাপড় ও পবিত্র কোমরবন্ধনী পরানো হয় দেহে। এগুলো যথাক্রমে ‘সুদ্রেহ’ ও ‘কুষ্টি’ নামে পরিচিত। চিরনিদ্রায় শায়িত দেহকে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসা হয়। তার আগে পারসি পুরোহিতরা মৃত ব্যক্তির শান্তি কামনা করে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রার্থনা করেন। রতন টাটার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানেও দেখা গেছে, গান স্যালুট ও শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আত্মীয়-স্বজন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বের হয়ে গেলে, সাদা রঙয়ের বিশেষ পোশাক পরিহিত কয়েকজন পারসি ধর্মগুরু শ্মশানে প্রবেশ করছেন।
পারসিরা ভারতের সংখ্যালঘু ধনী সম্প্রদায়
ভারতে জনসংখ্যার হিসেবে অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু ইতিহাসে সবচেয়ে বিত্তশালী ও সফল সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম পারসি সম্প্রদায়। অর্থাৎ প্রাচীন পারস্যদেশের (ইরান) জরথুস্ত্রপন্থী জাতিবিশেষ। হাজার বছর ধরে ক্ষুদ্র এই গোষ্ঠী বসবাস করে আসছে ভারতে।
ভারতের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারসি সম্প্রদায়ের অবদান অনস্বীকার্য। ভারতের প্রথম স্টিল মিল, প্রথম বাণিজ্যিক বিমান পরিবহন ব্যবস্থা, প্রথম বিলাসবহুল হোটেল, এশিয়ার প্রথম স্টক এক্সচেঞ্জ এগুলোর প্রতিটির পেছনেই রয়েছে কোনো না কোনো পারসির হাত।
পারসিক ধর্ম কী
অষ্টম থেকে দশম শতকে ইরান থেকে জরথুস্ত্রপন্থিরা ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে ঠাঁই নেয়। পারসি সম্প্রদায়ের লোকেরা যে ধর্মে বিশ্বাস করে, তার নাম হলো ‘জরথুস্ত্রবাদ‘ বা ‘পারসিক ধর্ম।’ অতিপ্রাচীন এই ইরানীয় ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন জরথুস্ত্র। আবেস্তা বা জেন্দাবেস্তা তাদের ধর্মগ্রন্থ।
সপ্তম শতাব্দীতে পারস্য (ইরান) ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমদের পারস্য বিজয় পতন ঘটায় সাসানীয় সাম্রাজ্যের। এই বিজয়ে পারস্যে ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে জরথুস্ত্রীয় ধর্মের প্রভাব। এরপর থেকে ছোট ছোট পারসিকদের দল খণ্ড খণ্ডভাবে আসতে থাকে ভারতে। ঐতিহাসিকদের মতে, দুই কারণে পারসিরা পাড়ি জমান ভারতে। প্রথমত: নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ। দ্বিতীয়ত: অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।
পারসিদের ভারত আগমন নিয়ে মজার একটি কিংবদন্তি চালু আছে। শুরুতে ক্ষুদ্র জনসংখ্যার একটি পারসি সম্প্রদায় আরব সাগর পাড়ি দিয়ে পা রাখে ভারতে। তৎকালীন গুজরাটের সাঞ্জান শহরের শাসক ছিলেন সম্রাট জাদি রানা। সেই সম্রাটের সঙ্গে কথাবার্তার জন্য পাঠানো হয় জরথুস্ত্র এক পুরোহিতকে।
তিনি রাজাকে বলেন, আপনার রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে থাকতে দিলে আমাদের বেশ উপকার হয়। কিন্তু রাজা অপরিচিত এই সম্প্রদায়কে নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তিনি তাদের দুধে কানায় কানায় পূর্ণ একটি বাটি দেখিয়ে বললেন, আমার রাজ্যে জনসংখ্যার অবস্থা এই দুধের বাটির মতোই। অতিরিক্ত আরেকটু যুক্ত হলেই উপচে পড়ে যাবে। পুরোহিত তখন রাজার কাছে একমুঠো চিনির আবদার করেন। চিনি নিয়ে আসা হলে সেই চিনিকে দুধের পাত্রে মিশিয়ে দেন পুরোহিত। বলেন, দুধে এই চিনির মিশ্রণের মতোই আমরা আপনার রাজ্যে প্রজাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকব।
পুরোহিতের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হন রাজা। তাদেরকে দেওয়া হয় থাকার অনুমতি। কিন্তু এর সঙ্গে কিছু শর্ত জুড়ে দেন তিনি। তা হলো-
পারসি নারীদের অবশ্যই শাড়ি পরিধান করতে হবে। পারসি পুরুষেরা কোনো অস্ত্র বহন করতে পারবে না। পারসি ধর্ম সম্পর্কে রাজাকে বোঝাতে হবে। গুজরাটি ভাষা শিখতে হবে।
পরবর্তী কয়েকশো বছরে আরও ছোট ছোট কিছু পারসি গোষ্ঠী বসতি গড়ে গুজরাটের সাঞ্জান এলাকায়। তাদের সম্মানার্থে ১৯২০ সালে সাঞ্জান স্তম্ভ নামে এক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাঞ্জান শহরের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় পারসিরা ভারতের অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ পাড়ি জমায় মুম্বাইয়ের পথে। সেজন্য বর্তমানে ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পারসি পাওয়া যায় মুম্বাই শহরে।
তারা মনোনিবেশ করে ব্যবসা এবং কারুশিল্পের দিকে। ব্রিটিশরা মুম্বাই আসার পর ব্যবসায়ী ও কারুশিল্পীদের খোঁজ করতে থাকলে মুম্বাইয়ে পারসিকদের চাহিদা বেড়ে যায়।
ব্রিটিশ শাসনামলে তারা সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পাঠানো শুরু করে। পারসিদের সন্তানেরা শিখে ফেলে ইংরেজি ভাষা, আয়ত্ত করে পশ্চিমাদের আচার-ব্যবহার, যেটা সে সময়ের জন্য বিলাসপূর্ণ চালচলন হিসেবেই গণ্য করা হতো। এজন্য তারা নিজেদের এক ব্যক্তিত্বশালী সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। তখন পারসি মাত্রই ছিল শিক্ষিত, প্রগতিশীল এবং সফল এক সম্প্রদায়। তা ব্রিটিশ এবং ভারতীয় কেউই অস্বীকার করত না।
পারসিদের বংশবিস্তার
পারসিদের অনন্য সাধারণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তারা দানশীলতার সঙ্গে যুক্ত। রতন টাটাও মানবকল্যাণে তার সম্পদের একটা অংশ ব্যয় করেছেন। সমাজ ও নিজ সম্প্রদায়ের উন্নয়নে তারা দানকর্মে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এই শিক্ষা অবশ্য জরথুস্ত্র ধর্মের মূল ভিত্তিতেও রয়েছে। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, সর্বদা সৎ কাজ করলেই মন্দকে দূরীভূত করা সম্ভব।
বর্তমান ভারতের পারসি ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৬০ হাজারের কাছাকাছি। পারসি জনসংখ্যা কমার পেছনে সন্তান জন্মদানে অনীহা, বিলম্বে বিয়ে এবং দেশান্তরকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার পারসি নারীর সঙ্গে অ-পারসি পুরুষের মিলনে জন্ম নেওয়া সন্তানকে পারসি হিসেবে গণ্য না করাও বড় একটি কারণ।
সংখ্যার বিচারে তারা অল্প হলেও ভারতীয় অর্থনীতিতে পারসিদের অবদান দেখলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। টাটা পরিবার, গোদরেজ পরিবার, ওয়াদিয়া পরিবারের নাম ভারতীয় শিল্পপতি পরিবারগুলোর তালিকায় বেশ ওপরের দিকেই রয়েছে। এমনকি ভারতীয় অভিনেতাদেরও বিশাল একটি অংশ পারসি ধর্মাবলম্বী।
জরথুস্ত্রবাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, পারসিদের বংশের ধারা প্রবাহিত হয় শুধুমাত্র পুরুষদের মাধ্যমে। অর্থাৎ একজন পারসি পুরুষের সঙ্গে যদি একজন অপারসি নারীর বিয়ে হয়, তাদের সন্তান হবে পারসি। অপরদিকে যদি একজন অপারসি পুরুষের সঙ্গে একজন পারসি নারীর বিয়ে হয়, তাদের সন্তানকে সেক্ষেত্রে পারসি বলা যাবে না।