মুখোমুখি ইরান-যুক্তরাষ্ট্র: বছরের সূচনালগ্নেই যুদ্ধের ঘণ্টা?

মধ্যপ্রাচ্য, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 06:38:22

অনেক আশাবাদের আলোয় নতুন বছর ২০২০ এলেও বছরের সূচনালগ্নেই বাজলো যুদ্ধের ঘণ্টা। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতময় ও যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতিতে যেন আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের দামামা শোনা যাচ্ছে। ইরানি জেনারেল কাসিম সোলাইমানিকে হত্যা এবং তারপর আরেক দফা হামলার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেমনই বার্তা জানিয়েছে।

ইরান-মার্কিন সম্পর্ক বৈরীতার মধ্য দিয়ে চলছে সেই ১৯৭৯ সাল থেকে। সে বছর রেজা শাহকে হটিয়ে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হলেও মার্কিনিরা সাহায্য ও সমর্থন করে শাহকে। শাহকে নিরাপদে পালাতে ও নির্বাসনে থাকতে পূর্ণ মদদ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

প্রতিক্রিয়ায় ইরানের বিপ্লবীরা রাজধানী তেহরানে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করে সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জিম্মি করে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের আমল। বৈরীতা তখন থেকেই।

পরবর্তী রিগান, বুশ (সিনিয়র ও জুনিয়র), ওবামা হয়ে ট্রাম্পের আমল পর্যন্ত সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে, যদিও আফগানিস্তানের সুন্নি তালেবান ও ইরাকের সুন্নি আইএস দমনে ইরান ছিল মার্কিনীদের সহযোগী।

ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সাহায্য পান সাদ্দাম, যদিও পরে তিনিও প্রাণ হারান মার্কিনীদের হাতে।

ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে ইসরায়েল সব সময়ই সঙ্গী ছিল আর এখন মার্কিনীদেরকে ইরান প্রশ্নে সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব।

ইরান-মার্কিন বৈরীতার সামরিক প্রকাশ মাঝে মাঝে হরমুজ প্রণালীতে পরিলক্ষিত হলেও বাণিজ্যিক প্রভাব দেখা গেছে সর্বদাই। মার্কিনীরা ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে চলেছে, যেমনটি তারা সময় সময় করেছে উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে।

তবে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বাত্মক। ইরানের সম্পদ আটক ছাড়াও আমদানি, রফতানি, বাণিজ্য সম্পর্ক বন্ধ করেছে মার্কিনীরা এবং কোনও দেশকেও করতে দিতে চাচ্ছে না। প্রায়-একঘরে হয়েও ইরান টিকে আছে আশ্চর্যজনক ঐক্য ও সংহতির কারণে।

অবরোধের কারণে ইরান তেল বিক্রিতে পিছিয়ে আছে। ন্যায্য দামও পাচ্ছে না। ইরানের উৎকৃষ্ট বাদাম, ফল, কার্পেট, উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে পারছে না। যতটুকু পারছে, তা-ও গোপনে, চোরাপথে ও কম দামে।

তথাপি ইরান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এমনকি সামরিক দিক থেকে ভেঙ্গে পড়েনি। বরং অবরোধের মুখে নিজেদের সক্ষমতা ও উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, শিল্প বিকাশ, সামরিক নির্মাণ ইত্যাদিতে ইরান উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে।     

ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক অভিযোগ হলো, দেশটি পারমাণবিক শক্তি অর্জন করছে। ইরান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, 'আত্মরক্ষার অধিকার সবারই আছে।'

যুক্তরাষ্ট্র অতীতে যেসব অভিযোগ এনে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে আক্রমণ করেছে, তেমন সকল অভিযোগই ইরানের বিরুদ্ধে খাড়া করেছে। কিন্তু তারপরেও ইরানের ভেতরে ঢুকতে পারছেনা বা ঢুকার সাহস পাচ্ছেনা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো পৃথিবীর এমন এক দেশ, যে দেশ বিভিন্ন দেশে আক্রমণ ও হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে অগ্রণী। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা মহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যত আগ্রাসন চালিয়েছে, ততটা আর কেউ করেনি। তথাপি সেই ১৯৭৯ সাল থেকে হুঙ্কার দিয়ে ইরানকে বাইরে বাইরে ক্ষতি করলেও ভেতরে পা ফেলতে পারছেনা। এর কারণ কি?

ইরানকে সরাসরি আক্রান্ত করতে না পারার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত ইরান শিয়া ইসলামের ভিত্তিতে ইমামের নেতৃত্বে প্রচণ্ডভাবে ঐক্যবদ্ধ। শিয়ারা খলিফার শাসন মানে না, মানে ইমামের শাসন এবং ইমামকে মনে করে ঐশ্বরিক পদ। তার নির্দেশে জান বাজি রাখতেও প্রস্তুত ইরানিরা। ফলে ইরানের ভেতরে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংহতিতে কোনও ফাটল ধরিয়ে সেখানে প্রবেশ করা কারও পক্ষেই অসম্ভব।

দ্বিতীয়ত, ইরান ভেতরের ঐক্যের পাশাপাশি আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক ভাবেও কৌশলজনক অবস্থান নিয়ে চলে। পাশের সিরিয়া, ইরাক ছাড়াও দূরের রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেনের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক চমৎকার। বিশেষ করে, মার্কিন বিরোধিতার মুখে ইরান কাছে নিয়েছে রাশিয়াকে। ফলে, আন্তর্জাতিকভাবে ইরানবিরোধী মোর্চা গঠন করাও কষ্টকর।

তৃতীয়ত, ইরান আর্থিক ও সামরিক দিয়ে অন্য মুসলিম দেশের মতো ভঙ্গুর নয়। তাদের নিজস্ব সামরিক উৎপাদন, সুদক্ষ বাহিনী ও অত্যাধুনিক অস্ত্র সম্ভার রয়েছে। বিশ্বের যেকোনও শক্তিকে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে পাল্লা দিতে সক্ষম ইরান।

ফলে ইরান প্রসঙ্গে সামাজিক অনৈক্য, রাজনৈতিক বিভেদ, আর্থিক দুর্বলতা, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক সুবিধা ও সামরিক অদক্ষতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়া বানাতে পারবেনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যা পারবে, তাহলো বাইরে থেকে আক্রমণ করে ইরানকে দুর্বল করা। জেনারেল কাসিম সোলাইমানি হত্যা তেমনই একটি পদক্ষেপ। মার্কিনীরা চাইবে ইরাক ও সৌদি আরবকে ভর করে ইরানকে ধরতে। কারণ, এ দুটি দেশেই তাদের সামরিক ঘাঁটি ও সমর্থন আছে।

ইরান এমন পরিস্থিতিতে কি করবে? জেনারেল সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ ও মার্কিন আগ্রাসনের মোকাবেলা ইরান কেমন করে করবে? এসব প্রশ্ন গত চব্বিশ ঘণ্টার পুরোটা সময়ই পৃথিবীর সর্বত্র আলোচিত হয়েছে।

সিএনএন, বিবিসি, আল জাজিরা, নিউজ ফোর ইত্যাদি নেতৃস্থানীয় মিডিয়া এসব প্রশ্নে জোরালো আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা কথা বলেছেন। তাদের মতে, ইরানের প্রতিশোধ হবে কৌশলী। সাধারণত ইরান 'সফট টার্গেট'-এ আক্রমণ করে। অতীতের সেই ধারা ইরান আরও বাড়িয়ে দেবে।

'সফট টার্গেট' বলতে মার্কিন ও তার মিত্রদের স্পর্শকাতর, কৌশলগত ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও স্থাপনাকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের কোনও কোনও ব্যক্তি বা বিষয় ইরানের টার্গেট হবে। ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের যোদ্ধা ও সিরিয়ার আসাদের বাহিনীকে মার্কিন ও তার মিত্রদের বিপদগ্রস্ত করতে কাজে লাগাবে ইরান। 

মোদ্দা কথায়, ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীন বৈরীতা জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আরও নাজুক হওয়ায় তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধাবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে এর ফলে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিচক্ষণ পূর্বসূরিরা ইরানের সঙ্গে বৈরীতা সত্ত্বেও দেশটিকে সরাসরি ঘাটাতে সাহস পায়নি। ট্রাম্প আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা ও সমর্থনের পারদ বাড়াতে এক পা আগে বেড়ে ইরানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক লড়াইয়ের ঢঙ্কা বাজিয়ে ফেলেছেন। এতে সফল হলে ট্রাম্পের জন্য ভালো। নইলে নিজের বারোটা বেজে যাওয়ারও আশঙ্কা আছে একগুঁয়ে ট্রাম্পের। বছরের শুরুতেই যুদ্ধের ঘণ্টা বাজিয়ে তিনি ইরানকে শায়েস্তা করতে পারবেন, নাকি নিজেরই বিদায় ঘণ্টা বাজাবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর