হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষের গোনাহ যদি হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিমের পাথরকে স্পর্শ না করতো, তাহলে যেকোনো অসুস্থ ব্যক্তি তা স্পর্শ করলে (আল্লাহর পক্ষ হতে) তাকে সুস্থতা দান করা হতো।’ -সুনানে কুবরা, বায়হাকি: ৫/৭৫; শরহুল মুহাযযাব: ৮/৫১
হাদিসে বর্ণিত দুই পাথরের একটি হাজরে আসওয়াদ পবিত্র কাবার দেয়ালে লাগানো। অন্যটি কাবা শরিফের পূর্বদিকের তাওয়াফের স্থানে ক্রিস্টালের একটা বাক্সে বর্গাকৃতির একটি পাথর চারদিকে লোহার বেষ্টনী দিয়ে রাখা আছে। পাথরটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান প্রায় এক হাত। এই পাথরটিই মাকামে ইবরাহিম। মাকামে ইবরাহিমের কাছে বা ঘেঁষে অনেক মুসল্লি নামাজ পড়েন, অনবরত চলে তাওয়াফ। তবে এটার স্পর্শ কিংবা চুমো দেওয়া কিংবা এটা দেখতে হবে অথবা ছুঁতে হবে- এমন কোনো বিধান নেই। তার পরও অনেকে এটা ছুঁতে কিংবা স্পর্শ ও চুমো খেতে চেষ্টা করেন। অবশ্য মাকামে ইবরাহিমের কাছে নিয়োজিত সৌদি পুলিশ, তা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেন। তার পরও মাকামে ইবরাহিমকে ঘিরে ভিড় পরিলক্ষিত হয়।
মাকাম শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে- দাঁড়ানোর স্থান। অর্থাৎ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাসের দাঁড়ানোর স্থান। এই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) কাবা শরিফ নির্মাণ করেছেন। পাথরের ওপর তার কদম মোবারক রাখলেই সেটা নরম হয়ে যেত এবং হজরতের কদম মুবারক পাথরের ভিতর চার আঙ্গুল পরিমাণ দেবে যেত, যাতে নির্মাণ কাজের সময় পা পিছলে না যায়। কোনো কোনো বর্ণনায় বলা হয়েছে, পাথরটি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ইচ্ছানুযায়ী ওপরে-নিচে, ডানে-বামে নিয়ে গিয়ে নিজ প্রয়োজন অনুসারে কাজ করেছিলেন অবলীলায়। কাবাঘর নির্মাণ শেষে পাথরাটি কাবা ঘরের পাশে রেখে দেওয়া হয়। কালের বিবর্তনে পাথরটি বর্তমান স্থানে রাখা হয়েছে।
এক মিলিয়ন রিয়াল ব্যয় করে মাকামে ইবরাহিম রাখার বক্সটি বানানো হয়েছে। পিতল ও ১০ মিলি মিটার পুরো গ্লাস দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এটি। ভেতরের জালে সোনা চড়ানো। হাজরে আসওয়াদ থেকে মাকামে ইবরাহিমের দূরত্ব ১৪.৫ মিটার।
কোরআনে কারিমে এ পাথরকে প্রকৃষ্ট নিদর্শন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘এতে রয়েছে ‘মাকামে ইবরাহিমের’ মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো, মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য। যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা মানে না, আল্লাহ সারাবিশ্বের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না।’- সূরা আল ইমরান: ৯৭
তাফসিরে তাবারিতে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বায়তুল্লাহতে আল্লাহতায়ালার কুদরতের পরিষ্কার নিদর্শন রয়েছে এবং খলিলুল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-এর নিদর্শনাবলী রয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো- তার খলিল ইবরাহিম (আ.)-এর পদচিহ্ন ওই পাথরে যার ওপর তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। -তাফসিরে তাবারি: ৪/১১
বিধান অনুযায়ী, পবিত্র কাবাঘরের তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহিমের পেছনে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হয়। তবে জায়গা না পেলে কাবা চত্বরের অন্য কোথাও আদায় করলে নামাজ হয়ে যায়। তবে এটা ঠিক যে, সাধারণ মূল্যহীন পাথরটি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সংস্পর্শে এসে অনন্য মর্যাদার অধিকারী হয়েছে।
মক্কার উম্মুল জুদস্থ জাদুঘরের ভারপ্রাপ্ত কর্র্মকর্তা সালেহ বিন আবদুর রহমানের সূত্রে জানা গেছে, চার হাজার বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও মাকামে ইবরাহিমে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পদচিহ্ন অপরিবর্তিত রয়েছে। পাথরটির ওপর প্রতিটি ছাপের দৈর্ঘ্য ২৭ সেমি এবং প্রস্থ ১৪ সেমি। পাথরের নিচের অংশে রূপাসহ প্রতিটি পাথরের দৈর্ঘ্য ২২ সেমি এবং প্রস্থ ১১ সেমি। পাথরটিতে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পদচিহ্নের গভীরতা পাথরটির উচ্চতার অর্ধেক, ৯ সেমি।
দীর্ঘদিন ধরে লাখ লাখ নবীপ্রেমিকের হাতের স্পর্শের পরও আঙুলের চিহ্নগুলো এখনো বিদ্যমান। ভালো করে লক্ষ্য করলে এখনও বোঝা যায় আঙুলের চাপ, বোঝা যায় পায়ের গোড়ালির চিহ্ন। আগে পাথরটি প্রয়োজনে স্থানান্তর করা যেত। জাহেলি যুগে লোকেরা বন্যার ভয়ে মাকামে ইবরাহিমকে কাবা শরিফের সঙ্গে লাগিয়ে রাখত। হজরত উমর (রা.)-এর খেলাফতকালে এটি সরিয়ে বর্তমান জায়গায় বসানো হয়। একসময় পাথরটিকে একটি মিম্বরের ওপর তুলে রাখা হয়েছিল, যেন বন্যার পানি এর নাগাল না পায়। যুগে যুগে বহু শাসক মাকামে ইবরাহিমের সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নেন। ১৬০ হিজরিতে খলিফা মাহদি হজে এসে মাকামে ইবরাহিম পাথরটির ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত রূপা দিয়ে মজবুত করে মুড়িয়ে দেন। আগে মানুষ পাথরটি হাতে ধরে দেখার সুযোগ পেয়েছিল। এখন শুধু দেখা যায়, ধরা যায় না।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর শেষ জীবনের ইবাদতের স্থান মাকামে ইবরাহিম। এর প্রতিটি অনুকণা খলিলুল্লাহর অশ্রু ধারায় সিক্ত বা সিঞ্চিত। তার কর্মের অঙ্গন বিশ্ব মুসলিমের ইবাদতের স্থান। দিন-রাত এ স্থান জনাকীর্ণ। হজ ও উমরা পালনকারীরা তাওয়াফ শেষে এখানে দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহতায়ালার দরবারে পাপমুক্তি ও স্বীয় মনোবাসনা কামনা করে মোনাজাত করেন।