পৃথিবীটা কোনদিকে যাচ্ছে? বড় বড় রাষ্ট্রগুলো যে পথে চলছে, তাতো শান্তির পথ নয়। ফলে সঙ্কটের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতাও। শুধু অস্ত্রের সংখ্যাই যে বাড়ছে তা নয়, বাড়ছে ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষমতাও। যে সভ্যতায় মানুষ ও জনপদ ধ্বংসের এত আগ্রহ, সেই সভ্যতাকে কি মানবিক সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা যায়? মানুষ তো দু’টি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, তার ফলাফল কি মানুষ ভুলে গেছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞই তো মানুষকে শান্তির কথা ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছিল। সে কারণেই ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতিসংঘ। এরপর ৭৫টি বছর কেটে গেছে, কিন্তু জাতিসংঘ তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরাশক্তিগুলো। পরাশক্তির দাম্ভিক ও অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জাতিসংঘ পরিণত হয়েছে একটি ভীরু সংস্থায়।
কিন্তু মানুষ চায় জাতিসংঘ তার নৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগ করুক। এ পথে বিরাজমান বাধা দৃশ্যমান। সে বাধা দূর করার কাজই এখন মানবজাতির প্রধান কাজ হিসেবে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। তবে বিশ্ববাতাবরণে তেমন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অবশ্য মানবতাবাদী চিন্তাশীল মানুষরা শান্তির পক্ষে, নৈতিক কর্তৃত্বে বলীয়ান জাতিসংঘের পক্ষে কথা বলছেন, দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর রাজনীতিবিদরা চলছেন ভিন্ন পথে। উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা তো অনেকের সঙ্গত ও স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতাও হরণ করে নিয়েছে। এটাই এখন বিশ্ববাসীর জন্য রূঢ় বাস্তবতা। তার অর্থ কী বিশ্ব শান্তি সুদূর পরাহত? উত্তর, না।
বিশ্ববাসীর সামনে বিদ্যমান হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনালেখ্য। একমাত্র রাসূলের আদর্শ অনুসরণেই শান্তিময় সমাজ গঠন সম্ভব। ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র এখন শতভাগ সাফল্য অর্জন সম্ভব- রাসূলের দেখানো পথে জীবন চলার মাধ্যমে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তারুন্যদীপ্ত যৌবনকালের কথা বলতে পারি। তারুণ্যের তাড়নায় যৌবনে নানা রকম উচ্ছৃংখলতার ছাপ পড়ে। সমাজে প্রবাহমান কোনো না কোনো খারাপ প্রভাব যুবকদের চরিত্রে রেখাপাত করে থাকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যৌবনকাল ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম, সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নির্মল। তৎকালীন সমাজের কোনো অনাচার, অনিয়ম ও অশ্লীলতার প্রভাব তার চরিত্রে পড়েনি। বরং তিনি সমাজের তখনকার খারাপ চিত্র দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন। মানুষ সমাজের কল্যাণ সেবা চিন্তায় অধীর হয়ে ওঠেন। তাই বিশ বছর বয়সে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সেবামূলক সংস্থা হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংস্থার মাধ্যমে তিনি যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করে সমাজের অসহায় বিশেষ করে এতিম ও বিধবাদের সহায়তা দান করেন। মানুষকে নানা ধরনের অন্যায়-অবিচার থেকে রক্ষা করতে ব্রতী হন। অভাবী মানুষের অভাব পূরণ এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সেবা করাই ছিল এ সংস্থার উদ্দেশ্য।
বর্তমান বিশ্বের হতাশাগ্রস্ত অধঃপতিত যুব সমাজ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিলফুল ফুজুল থেকে অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, পারে মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগের প্রেরণা গ্রহণ করতে। আজকের যুব সমাজ সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মাদকাসক্তি, ছিনতাই, রাহাজানি ও সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। তরুণ সমাজ যদি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে তাহলে সব অন্যায় ও পাপাচার থেকে মুক্ত হয়ে তাদের পক্ষে শান্তির সমাজ গড়া সম্ভব হবে। সুতরাং আমাদের যুব সমাজকে রাসূল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণে উদ্ধুদ্ধ করা সময়ের অপরিহার্য দাবি।
শুধু উল্লেখিত বিষয় নয়, নবীর জীবনের পরিপূর্ণ অনুসরণ জরুরি। বিশেষ করে জীবনাচারের মতো বিষয়গুলো। যেমন আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করা ও আত্মসংবরণশীল হওয়া এক মহৎ গুণ। ধৈর্যের মহত্ততার দিকে লক্ষ্য রেখে আল্লাহতায়ালা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে আদেশ প্রদান করে বলেন, অতএব, তুমি ধৈর্যধারণ করো; যেমন ধৈর্যধারণ করেছেন পূর্ববর্তী রাসূলগণ। -সূরা আহকাফ: ৩৫
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন, এমনকি ধৈর্যধারণ তার অনন্য ও সুমহান চরিত্রে মূর্তমান হয়েছে। তিনি রেসালতের দায়িত্ব পালনের স্বার্থে দাওয়াতের কণ্টকাকীর্ণ পথে দীর্ঘ তেইশ বছর ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। যাবতীয় প্রতিকূলতার মুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিচলিত কিংবা রাগের বশবর্তী হননি।
যেমন কোরাইশ কর্তৃক তাকে প্রহার, তার পিঠের ওপর উটের নাড়িভুঁড়ি তুলে দেওয়া, আবু তালেব উপত্যকায় তিন বছর পর্যন্ত তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা; তার প্রতি অধিকাংশ লোকের বৈরী আচরণ; জাদুকর, গণক ও পাগল ইত্যাদি অবমাননামূলক উপাধি দ্বারা আখ্যা দেওয়া, হিজরতের রাতে হত্যার প্রয়াস, মদিনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার লক্ষ্যে কোরাইশের সৈন্য সমাবেশ ও যুদ্ধ প্রস্তুতি, মদিনায় তার বিরুদ্ধে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, পরস্পর সম্পাদিত চুক্তি ইহুদি কর্তৃক ভঙ্গ, রাসূলকে হত্যার জন্য ইহুদিদের চেষ্টা ও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সংগঠিত করা।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এবং তার সাহাবিগণ ও পরিবারবর্গ আহারের ক্ষেত্রেও ধৈর্যধারণ করেছেন। এমনকি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও একদিনে দু’বেলা যবের রুটি পেট ভরে খেতে পারেননি। কখনও চুলায় আগুন জ্বলত না। অধিকাংশ সময় তাদের খাবার থাকতো খেজুর আর পানি।
অথচ বর্তমান বিশ্বে প্রতি বছর নষ্ট হয় উৎপাদিত মোট খাবারের এক তৃতীয়াংশ। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অথচ জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসূলের আদর্শ ও দেখানো পথ অনুসরণ করলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। সাফল্যে ভরে ওঠবে জীবন। চলতি রবিউল আউয়াল মাসে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।