আট হাজার ৭২২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নত মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই প্রতিশ্রিুতির আলোকে সরকারি অর্থায়নে মসজিদগুলো নির্মিত হচ্ছে। একসঙ্গে এতো মসজিদ নির্মাণের ঘটনা এই প্রথম।
নির্মাণাধীন মসজিদের মধ্যে ৫০টি মডেল মসজিদ আগামী বছরের মার্চের মধ্যে নামাজ শুরুর মাধ্যমে উদ্বোধন করতে যাচ্ছে গণপূর্ত। বাকিগুলোর কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। তবে নানা জটিলতায় পুরো মসজিদ প্রকল্পের কাজ শেষ সময় আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিটি মডেল মসজিদে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা ছাড়াও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। জেলা সদরে নির্মিত মসজিদগুলো হচ্ছে চারতলা এবং উপজেলায় হচ্ছে তিনতলা কমপ্লেক্স। এর মধ্যে নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক অজুর স্থান, লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র, শিশু শিক্ষা, বিদেশি পর্যটকদের আবাসন, অতিথিশালা, হজযাত্রীদের নিবন্ধনকেন্দ্র ও ইমামদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। জমির ধরন ভেদে প্রতিটি মসজিদ নির্মাণের জন্য ব্যয় হচ্ছে ১২ থেকে ১৬ কোটি টাকা।
৫৬০টি মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মধ্যে ৪০০টির কাজ শুরু হয়েছে। বাকি ১৫৫টি মসজিদ নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। পাঁচটি মসজিদের ভূমি নিয়ে আদালতে মামলা থাকায় অধিগ্রহণ শেষ করতে পারেনি গণপূর্ত।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২১ সালের ১৭ মার্চের আগেই ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করতে চায় গণপূর্ত। ৫০টি মসজিদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের সাভার, ফরিদপুরের মধুখালী, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর, পাকুন্দিয়া ও কটিয়াদি, মানিকগঞ্জের শিবালয়, রাজবাড়ী সদর, শরীয়তপুর সদর ও গোসাইরহাট উপজেলা রয়েছে।
এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগের বগুড়ার সারিয়াকান্দি, শেরপুর ও কাহালু, নওগাঁর সাপাহার ও পোরশা, পাবনার চাটমোহর, সিরাজগঞ্জ জেলা ও উপজেলা সদর এবং রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী ও পবা উপজেলার মসজিদ মার্চে উদ্বোধন করা হবে।
এর বাইরে রংপুর বিভাগের দিনাজপুরের খানসামা ও বিরল, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, পঞ্চগড় সদর ও দেবীগঞ্জ, রংপুরের জেলা ও উপজেলা সদর, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও বদরগঞ্জ এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার মডেল মসজিদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর সদর উপজেলা এবং ময়মনসিংহের তারাকান্দা ও গফরগাঁও উপজেলার মসজিদ মার্চে উদ্বোধন করা হবে। বরিশাল বিভাগের ভোলা সদর ও ঝালকাঠির রাজাপুরে মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষের দিকে। চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম জেলা সদর, লোহাগাড়া, মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কুমিল্লা দাউদকান্দি, খাগড়াছড়ির পানছড়ি এবং নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার মসজিদের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে।
খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা ও খুলনা জেলা সদর এবং কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মসজিদও উদ্বোধন হবে মার্চে। এ ছাড়া সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মডেল মসজিদটির উদ্বোধন করা হবে মার্চে।
মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবং গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. নজিবর রহমান জানিয়েছেন, ‘মুজিববর্ষ উপলক্ষে ৫০টি মডেল মসজিদ মার্চের মধ্যে উদ্বোধনের লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ সময়ের মধ্যে মসজিদগুলোর কাজ শেষ হবে। এর বাইরে ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ৪০০ মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ হবে। বাকিগুলো একটু বিলম্ব হতে পারে।’
মসজিদ নির্মাণ মুসলমান সমাজের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মসজিদকেন্দ্রিক সমাজ। বহু স্থানে এর সঙ্গে যুক্ত আছে পাঠাগার, দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, ধর্মীয় পরামর্শ কেন্দ্র, মুসাফিরখানা, হেফজখানাসহ নানাবিধ শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমান। এখানকার প্রতিটি শহর, নগর, গ্রাম ও মহল্লায় মসজিদ রয়েছে। মসজিদ এ দেশের সমাজ ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ। এ অঞ্চলে অনেক অলি-বুজুর্গ, পীর-মাশায়েখ ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করতে এসেছেন। তাদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে অসংখ্য মসজিদ নির্মিত হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে মসজিদসংলগ্ন পুকুরঘাট, কবরস্থান, মুসাফিরখানা দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মসজিদভিত্তিক সমাজের প্রমাণ বহন করে। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মসজিদ আছে। এসব মসজিদের বেশিরভাগই স্থানীয় জনগণের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হয়।
মসজিদভিত্তিক সমাজের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ইসলামি মূল্যবোধের প্রসার ও ইসলাসি সংস্কৃতি বিকাশের উদ্দেশ্যে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার।
মডেল মসজিদগুলো হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। উপকূলীয় এলাকায় নিচতলা উন্মুক্ত রেখে ভবনটি নির্মিত হবে। অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী মুসল্লিদের জন্য আলাদা র্যাম্প থাকবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত্ব হলে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৪৪০ পুরুষ এবং ৩১ হাজার ৪০০ নারীর নামাজ পড়ার সুযোগ হবে।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে ৩৪ হাজার পাঠকের জন্য লাইব্রেরি সুবিধা নিশ্চিত হবে। ৬ হাজার ৮০০ গবেষকের গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রতিদিন ৫৬ হাজার মুসল্লি দ্বীনি দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পাবেন। প্রতি বছর ১৪ হাজার শিক্ষার্থী কোরআন শরিফ হিফজ করার সুযোগ পাবে। প্রতি বছর ১৬ হাজার শিশুর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা তৈরি হবে।
মডেল মসজিদে দৈনিক ২ হাজার ২৪০ জন দেশি-বিদেশি অতিথি আবাসন সুবিধা পাবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ প্রকল্পের আওতায় দেশের নয়টি স্থানে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এর পর শুরু হয় মসজিদ নির্মাণের কাজ।
মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো তৃণমূল পর্যায়ে ইসলাম ধর্মের সঠিক প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখবে। এগুলো আলেম-উলামাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফরম হিসেবে বিবেচিত হবে।
মডেল মসজিদের বাইরে সৌদি আরবের সহায়তায় দেশের আটটি বিভাগে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধাসহ আরও ৮টি ‘আইকনিক মসজিদ’ নির্মিত হবে। সম্প্রতি নব নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসেফ আল দুহাইলান প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় বাসভবন গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে আইকনিক মসজিদ নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা হয়।