কথায় আছে, অহঙ্কার পতনের মূল। অহঙ্কার আর দাম্ভিকতার বড়াই মানুষের জন্য সাজে না। কারণ মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাতে পরিণত হয়েছে। মানুষকে মানুষের জন্য, দুনিয়ার সব জন্তু-জানোয়ার, গাছপালা, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত সবকিছুর দায়িত্বশীল করে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই তাকে সর্বক্ষেত্রে সহজ-সরল আচার-ব্যবহার করে জীবনযাপন করতে হবে। নিজেকে কখনও অন্যের চেয়ে বড় ভাবা ঠিক নয়। চাল-চলনে কখনও অহঙ্কার প্রকাশ করা যাবে না। নিম্ন বংশ, সম্পদ, রূপ-সৌন্দর্য, সামর্থ্য ও শক্তির বড়াই করা যাবে না। কারণ এসব আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের জন্য, ভালো-মন্দ বাছাইয়ের জন্য পরীক্ষা হিসেবে ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, প্রকৃতি গড়নে সৌন্দর্য প্রকাশ করার সুযোগ আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন। অহঙ্কারের জন্য নয়। শয়তান তার অহঙ্কারের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্চনা ও আখেরাতে সাজা ভোগ করবে।
কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘অহঙ্কারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বড়াইকারী ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।’ –সুরা লোকমান : ১৮
কোরআনে কারিমে আল্লাহ আরও বলেন, ‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা জমিনের বুকে নম্রভাবে চলে। আর যখন জাহেল লোকেরা তাদের সম্বোধন করে তখন তারা তাদেরকে বলে ‘সালাম’।’ –সুরা ফুরকান : ৬৩
আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘আমার কাছে এই মর্মে অহি প্রেরণ করা হয়েছে, তোমরা সকলে বিনয়ী হও, যাতে কেউ কারও প্রতি বাড়াবাড়ি করতে না পারে এবং কেউ কারও কাছে গর্ব করতে না পারে।’ –সুনানে আবু দাউদ
নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, ‘অহঙ্কারী ও অহঙ্কারের মিথ্যা ভানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ –সুনানে আবু দাউদ
এভাবে অসংখ্য কোরআনের আয়াতে আল্লাহতায়ালা এবং হাদিসে নবী মুহাম্মদ (সা.) সহজ-সরলভাবে চলার জন্য এবং অহঙ্কার-দাম্ভিকতা, বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত থেকে দুনিয়ায় আল্লাহর সঠিক প্রতিনিধিত্ব করার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন।
লোভ-লালসা, দুনিয়ার চাকচিক্য, প্রাসাদ সমতুল্য বাড়িঘর, খাওয়া-দাওয়ার প্রাচুর্য আমাদের দুনিয়াদার বানিয়ে ফেলেছে। কথায় কথায় মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করা, কাজের লোকদের- যেমন চারক-বাকর, ঘরের কাজের বুয়া, ড্রাইভার, পিয়নদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার আমাদের কলুষিত করছে। আমাদের চাল-চলন, পোশাক-আশাক, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার প্রতিযোগিতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কোটি টাকার মোহর দিয়ে বিয়ের উদাহরণ আমাদের এই গরিব দেশে কিন্তু কম নয়। আবার এই বিয়েও ঘটা করে বিচ্ছেদ হওয়ার খবরও পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং আল্লাহর বাণী ও রাসুল (সা.)-এর শিক্ষার বিপরীত এবং পরিত্যাজ্য।
ঘরে খাবার-দাবারের মেন্যুতে ভাজি, ডাল, মাছ বা গোশতের আইটেম করলেই হয়ে যায়। কিন্তু ১০-১৫ আইটেমের খাবার পরিবেশনের খবর আমাদের কাছে আসে, যা না হলেও এ দুনিয়ায় চলে। শরীর ভালো রাখার জন্য সহজে পাওয়া যায় তাজা তরিতরকারি। আমাদের দেশে প্রচুর পাওয়া যায়। দাম কোনো কোনো সময় বাড়তি মনে হলেও বিদেশের তুলনায় কিন্তু কম। তাই খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সহজ পন্থা অবলম্বন করা খুবই জরুরি। বিদেশি ফল না কিনে দেশীয় ফল কিনুন। দামেও সস্তা। আবার পুষ্টিগুণও বেশি। সব সিজনেই কোনো না কোনো দেশি ফল বাজারে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লক্ষ করেছি খাওয়ার অপচয়। মানুষ কত খেতে পারে? কিন্তু চোখের দেখা, লোভ-লালসা খাদ্যের প্রাচুর্য, মেনুর বাহাদুরি সবকিছু মিলিয়ে প্লেট ভরে খাবার নিলেও কিন্তু খাওয়ার সময় আর সব খাওয়া যায় না। কারণ ইতোমধ্যে পেট আর গ্রহণ করছে না। পেটেরও তো সীমাবদ্ধতা আছে।
বস্তুত সবক্ষেত্রে সহজ-সরলপন্থা গ্রহণের মধ্যেই কল্যাণ। তাতা পেট খারাপের কোনো কারণ ঘটে না। সহজ-সরল জীবনযাপন কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ঘরে অভ্যাস করাতে হবে। বাচ্চাদের খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, খেলনাসামগ্রী সবগুলোতেই সাশ্রয়ী হতে শিক্ষা দিতে হবে। কোনো অপচয় করা যাবে না। নিয়মের মধ্যে বাচ্চাদের অভ্যাস করাতে পারলে তারা বড় হয়ে অপচয় করবে না। আবার আমাদের ব্যবহারেও যদি আমরা বড়রা সচেতন হই, তবে তারা সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হবে। দম্ভ-অহঙ্কার, বাড়াবাড়ি, অপচয় থেকে মুক্ত হয়ে ভালো মানুষ হিসেবে দুনিয়ায় উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে।
যেহেতু আল্লাহতায়ালা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে আমাদের বাস্তব জীবনে চলাফেরা, পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া, আচার-ব্যবহার, ছোটদের স্নেহ, বড়দের শ্রদ্ধা করার সব পদ্ধতি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। পেশ করেছেন আসহাবে সুফফাদের বাস্তব জীবন। আমাদের কাছে কিছু মজুদ আছে, তাদের পোশাক, তাদের খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানো সবই আমাদের কাছে জীবন্ত উদাহরণ।
আসুন, আমাদের দুনিয়ার জীবনটাকে সেভাবে সাজাই। যাতে করে দুনিয়ার এই স্বল্প জীবনের পথচলা সহজ হয়। সরলভাবে জীবন গড়ি। নিজে অপচয়, দম্ভ, অহঙ্কার, বাড়াবাড়ি পরিত্যাগ করি। অন্যদেরও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ার আহ্বান জানাই। দুনিয়াকে আখেরাতের শস্যক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে উত্তম ফসল ফলিয়ে চিরসুখী সীমাহীন জান্নাতের পুঁজি বাড়াই। আল্লাহতায়ালা সহজ-সরল জীবনযাপনকারীদের অবশ্যই দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম পুরস্কার দেবেন, কোনো সন্দেহ নেই।